আবু আহমদ আবদুল হাফিজ | জন্মশতবার্ষিকী স্মারক
আহবায়কের
কথা
চল্লিশের দশকে আমি যখন আইন
পেশায় যোগ দিই তখন পাকিস্তান আন্দোলনের চূড়ান্ত অধ্যায়। সিলেট জেলা বারে যে সব
প্রতিষ্ঠিত ব্যবহারজীবি তখন পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সেবক তাদের মধ্যে অন্যতম
মরহুম জনাব আবু আহমদ আবদুল হাফিজ। সিলেটের গণভোটে তাঁর দায়িত্ব ছিল গুরুভার।
সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি ছিলেন তরুন, চটপটে ও কর্মঠ। এই পরিচয়টি পরবর্তী প্রায়
চল্লিশ বছর তিনি অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন।
পাকিস্তান হাসিলের অব্যবহিত
পরেই শুরু হলো ভাষা আন্দোলন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
আমরা তখন যৌবনের জোয়ারে ঘোর প্রতিবাদী এবং রক্ষনশীল গোড়ামি আমাদের অসহ্য।
প্রগতিশীল বামপন্থী হিসেবে আমাদের আখ্যায়িত করে আমাদের উপর হামলা চলে। সেই সময়ে
বার লাইব্রেরীতে যে সব বর্ষীয়ান সদস্য অপেক্ষাকৃত তরুণ গোষ্ঠিকে সমর্থন ও সাহস দেন
তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাফিজ সাহেব ও শ্রদ্ধেয় মরহুম আবদুল্লাহ সাহেব।
যে স্মৃতি আমার কাছে সবচেয়ে
উজ্জ্বল তা হলো হাফিজ সাহেবের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং বিশেষ করে আমাদের আইন
কলেজের সংগে তাঁর সুদীর্ঘ সম্পর্ক। তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রতিষ্ঠাতা
অধ্যক্ষ হিসাবে এই কলেজের হাল ধরেন। বয়সের কারণে তাঁকে সত্বরই অবসরে যেতে হয়।
কিন্তু তাঁর প্রয়োজন আমরা এমন ভাবে অনুভব করি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ
ব্যবস্থা নিয়ে তাঁকে আবার কলেজের ভার নিতে আহবান জানানো হয়। তিনি এই আহবানে সাড়া
দেন এবং পরবর্তী প্রায় এক দশক এই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সংগে পালন করেন। কলেজের
উন্নতি, ছাত্রদের সুশিক্ষার পরিবেশ ও সহকর্মী শিক্ষকবৃদ্ধের সুখ সুবিধা হাফিজ
সাহেবের কাজে ও চিন্তায় সব সময় অগ্রাধিকার পেয়েছে। ১৯৮১ সালে তিনি আমাদের আপত্তি
অগ্রাহ্য করে অবসর গ্রহণ করেন। একজন শিক্ষক ও অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি যে মান নির্ধারণ
করে যান তাকে রক্ষা করাই তার উত্তরসুরী হিসেবে হয় আমার সাধনা। যতদিন তিনি
বেঁচেছিলেন কলেজটির জন্য বিশেষ করে কলেজের নিজস্ব দালানের জন্য, তিনি আপ্রান
চেষ্টা করে যান। অত্যন্ত সুখের বিষয় যে তাঁর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র কন্যাগণ
কলেজটির প্রতি সুনজর বহাল রাখেন।
আবদুল হাফিজ সাহেবের
কর্মোদ্দম আমাদের উৎসাহিত করতো। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ছিল মনোমুগ্ধকর। তাঁর বাচন ও
হাসি ছিল খুবই আকর্ষনীয়। তাঁর জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপন করতে পেরে আমরা খুবই
আনন্দিত ও গর্বিত।
মনির উদ্দীন আহমদ
আহবায়ক
আবু আহমদ আবদুল হাফিজ এডভোকেট
জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপন
পরিষদ
ও
অধ্যক্ষ, সিলেট আইন কলেজ।
অভ্যর্থনা পরিষদের আহবায়কের কথা
পূর্বসুরী
বিশিষ্ট আইনজীবী, শিক্ষানুরাগী, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী সর্বজন শ্রদ্ধেয় মরহুম আবু
আহমদ আব্দুল হাফিজ এডভোকেট-এর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন পরিষদের অভ্যর্থনা কমিটির
আহবায়ক হিসেবে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে শোকরিয়া আদায় করছি।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি পরিষদের সকল সম্মানীত সদস্যের প্রতি- যারা আমাকে অভ্যর্থনা
কমিটির আহবায়ক মনোনীত করে এ দুর্লভ সম্মান প্রদান করেছেন।
সিলেটের
কৃতি সন্তান প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিবৃন্দ অনুগ্রহ করে এ অনুষ্ঠানে তশরীফ এনে
আমাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন- তাঁদেরে জ্ঞাপন করছি আন্তরিক অভিনন্দন।
পৃথিবীর
সব সমাজেই কিছু মহৎ হৃদয়ের মানুষের জন্ম হয়- যাঁরা দেশ সমাজ ও জাতির কল্যাণের জন্য
নিবেদিত চিত্তে কাজ করে জাতিকে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ করেন। বিশিষ্ট আইনজীবী মরহুম
আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের মাধ্যমে
আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে প্রকারান্তরে নিজেরাই গৌরবান্বিত হচ্ছি। মনীষী
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন:
যে
সমাজ তার মহৎ লোকদের সম্মান করতে জানেনা, সে সমাজে মহা পুরুষের জন্য হয় না।
আবু
আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন অজাতশত্রু। তার কোন দুশমন ছিলনা। উদার হৃদয় ও অমায়িক
ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি সকলকে আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে অক্টোবর
মাসে সিলেট জেলা বারে যোগদান করেন। আমার শ্রদ্ধেয় চাচা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও
স্বনামধন্য আইনজীবী মরহুম শহীদ আলী ছিলেন তাঁর জুনিয়র। আজীবন তাদের মধ্যে ছিল
অনাবিল ভালবাসার সম্পর্ক। তারা উভয়ই ছিলেন একই আদর্শে বিশ্বাসী। দেশ ও সমাজের
একনিষ্ঠ খেদমতগার ।
আইন
পেশাকে তিনি মর্যাদার পেশা হিসেবে গণ্য করতেন। আইন পেশা কলুষিত হয় এমন কোন গর্হিত
কাজ তিনি জীবনে করেননি। তাঁর জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করার আছে।
মানুষের
জীবন কখনো সোজা সরল রেখায় চলে না। বহমান নদীর মত চলার পথে বাঁক পরিবর্তন হয় মানব
জীবনের। তাই দেখা যায় মরহুম আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের বর্ণাঢ্য জীবনে রাজনীতি,
শিক্ষা বিস্তার, আইনজীবী এবং সমাজ সেবার মত মহৎ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি
ছিলেন আপন বিশ্বাসে অটল। কোন ধরনের লাভ-লোভ তাঁকে এদিক-ওদিক করতে পারেনি। রাজনীতি
করে বাড়ী গাড়ী ধনদৌলত অর্জন করা যায় এটা তিনি কল্পনাও করেননি। তাঁর কাছে রাজনীতির
মাধ্যমে জনসেবা ছিল ইবাদত তুল্য।
পরিবর্তনশীল
পৃথিবী। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের মত ও পথের। বাঁক পরিবর্তন হচ্ছে
ইতিহাসের গতিধারার। মানুষে মানুষে মত ও পথের পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। যিনি যে
কাজটি করেন তা যদি মানব কল্যাণে নিবেদিত হয় তাহলে তাকে তার কাজের মাধ্যমেই
মূল্যায়ন করা উচিত।
মরহুম
আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ-এর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের মাধ্যমে যে মহৎ উদ্যোগটি গ্রহণ
করা হল তা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উৎসাহ ও প্রেরণার দৃষ্টান্ত হিসেবে
বিবেচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতবাসী
করুন- এই প্রার্থনা করি।
ফখর উদ্দীন আহমদ এডভোকেট
আহবায়ক অভ্যর্থনা উপ-পরিষদ
আবু আহমদ আবদুল হাফিজ এডভোকেট
জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপন পরিষদ
এবং
প্রেসিডেন্ট, সিলেট জেলাবার এসোসিয়েশন
নদীর উত্তরাধিকারে
(প্রয়াত
আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ স্মরণে)
দিলওয়ার
একদা
সুরমা নদী খুব বেশী খরস্রোতা ছিলো
বর্ষায়
দুকূলে তার শোনা যেতো ভাঙ্গনের ভাষা
সমস্ত
শরীরে ছিলো সামুদ্রিক সঙ্গম পিপাসা,
ধ্রুপদী প্রেমের স্বপ্নে আলিঙ্গনে গভীরতা ছিলো।
বাতাসে
বাজিয়ে ভেপু, নদী সভ্যতার ধারা বেয়ে
জাহাজ
আসতো যেতো, স্ফূর্তি পেতো রক্তের নাবিক
সিন্ধু
পাখীদের সাথে দেখা দিতো বিশ্ব-বৈতালিক
জ্বলতো অসংখ্য তারা অসংখ্য মৃতের প্রাণ পেয়ে।
এখনো
সুরমা আছে গতির অতীত নিয়ে মনে,
রাত
সুগভীর হলে মীন হয়ে প্রিয় নরনারী--
বুকে
তার খেলা করে জলে বাজে জলকেলি তারি,
নীলকণ্ঠ মীনগুলো রইবেই সমুদ্র মন্থনে।
নিরক্ষর
প্রকৃতির অলৌকিক রক্তের অক্ষর-
নদীরা
স্বরূপে এনে সৃষ্টি করে এক রত্নাকর।
-১৭ জুন ২০০০
ছবি
জীবনের
পরিমাপ দৈর্ঘ্যে প্রস্থে নয়
কর্মের
মাধ্যমে এর মাপজোক হয়।
আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ: যার যা প্রাপ্য
(২
জুন ১৯০০ - ৯ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৫)
*
সৈয়দ মোস্তফা কামাল *
এই পৃথিবীতে কত কোটি মানুষের
জন্ম-মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। ইতিহাসে পরিসংখ্যানে সবার খোঁজ
খবর পাওয়া যায় না। পাওয়া সম্ভব নয়। অপর দিকে যারা কত্তম জাতি ও আদর্শের জন্যে
ব্যক্তি স্বার্থ তুচ্ছজ্ঞান করে লাভলোভের ঊর্ধে
থেকে জিন্দেগীভর মানব কল্যাণে কাজ করেন তাঁদের কথা ইতিহাসে কয়। মানুষ তাঁদের ইয়াদ
করে শ্রদ্ধাভরে। নতুন প্রজন্ম তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে। কর্মবীর মরহুম আবু আহমদ
আব্দুল হাফিজ এডভোকেট ছিলেন তাঁদের একজন।
সিলেটরত্ন মরহুম আবু আহমদ
আব্দুল হাফিজ নিছক একজন ব্যক্তি ছিলেন না। বিগত শতাব্দিতে তিনি স্বীয় সাধনা, খালিস
নিয়তে কত্তম ও জাতির খেদমতের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে অবদান
রেখেছেন।
তাঁর সম্পর্কে বলা যায়:
সিলেটের
মাটি ও মানুষ ঋণী তাঁর দানে
অনাগত
কাল স্মরিবে তাহারে শ্রদ্ধায় প্রতিদানে।
তাঁর ঘটনা বহুল জীবনের পুরো
খতিয়ান একটি মাত্র প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমাদের জাতীয় মানস এখন খণ্ড বিখণ্ড।
মত ও পথের বেড়াজালে আবদ্ধ। ইতিহাসের অখন্ড ধারায় যদি মহৎ, ত্যাগী, কর্মবীর,
জননেতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবীদের মূল্যায়ন করা হতো তাহলে জাতীয় চিন্তা চেতনা মন
মানসে এমন বন্ধ্যাত্ম নেমে আসতো না।
কর্মবীর আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ
স্বাভাবিক মূল্যায়নে যা পাওয়ার হকদার দুঃখের বিষয় তাঁকে তা দেয়া হয়নি। সিলেটের
অনেক ত্যাগী ও কর্মবীরের মতো তিনিও বিস্মৃতির বিরাণ মরুভূমিতে হারিয়ে গেছেন। এটা
শুভ লক্ষণ নয়।
বলা হয়ে থাকে কৃতি পুরুষদের
জীবন চরিত ও ধ্যান ধারনাকে ধরে রাখার চর্চাই সঠিক সংস্কৃতি চর্চা। যুগে যুগে এরাই
দেশ সমাজ শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতির অঙ্গনে জাতিকে ধ্রুবতারার মতো দিক-নির্দেশনা
দেন। তাদের মহৎ কর্মকাণ্ডই জাতির প্রেরণার উৎস। বুকের সাহস।
মহাসাগরের তলদেশে অনেক
মণিমুক্তা মানুষের ধরা ছোয়ার বাইরে লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। মানব সমাজেও
এমনি ধরনের কিছু মানুষরত্ন থাকেন যাদেরে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে একটু দেরীতে।
কত্তম ও জাতির একনিষ্ঠ খেদমতগার আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন এমনি ধরনের এক দুর্লভ
মানবরত্ন। যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তারা আন্দাজ করতে পেরেছেন এই সহজ সরল জ্ঞানী
লোকটির ভেতরে ছিল কি ধরনের নিখাদ স্বজাতি প্রেম ও মানব কল্যাণের মিশনারী মানস।
মরহুম আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ।
হ্যাঁ, এ নামটির পেছনে রয়েছেন যে ব্যক্তিত্ব, তাঁর কাছে সিলেটবাসী তথা দেশবাসী বহু
ভাবে ঋণী। রত্ন প্রসবিনী সিলেটের যে সকল আদর্শ চরিত্রের ব্যক্তিত্বের কারণে সিলেটবাসী
গর্ববোধ করে, যে ক‘জন গুণীজনকে সিলেটবাসী সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধা করে মরহুম আবু
আহমদ আব্দুল হাফিজ তাদের একজন।
সৌভাগ্যের বিষয়, আমি আমার
ছাত্রজীবনে তাঁকে কাছে থেকে কিছুটা জানার ও বুঝার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার এই
যৎকিঞ্চিৎ জানা ও বুঝার মূল্যায়নের মানদণ্ডে সিলেটের সে সব ত্যাগী সমাজকর্মী
শিক্ষানুরাগী মাটি ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ কত্তম ও জাতির একনিষ্ঠ
খেদমতগার হিসেবে যাদেরকে শ্রদ্ধা করা হয় তিনি তাঁদের অন্যতম।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম আবু
আহমদ আব্দুল হাফিজ তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রায় অপরিচিত একটি নাম। তারা জানেনা বা
তাদেরকে জানার সুযোগ করে দেয়া হয়নি সিলেটের ইতিহাসে তাঁর গুরুত্ব ও তাৎপর্যময়
অবদানের কথা। হাল আমলে আমরা এক সুবিধাবাদী চানক্যতন্ত্রের গ্যাড়াকলে গেরেফতার। কেউ
কাউকে সহ্য করতে পারছিনা। আমাদের মনে রাখতে হবে ইমারতের ভিত ধ্বসে গেলে দালানটিও
খাড়া থাকতে পারে না। শিকড় মরা গাছ এমনিতেই বাঁচেনা। নদীর স্রোত ধারা বন্ধ হলে নাম
হয় মরাগাঙ।
কর্মবীর আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ
সম্পর্কে কিছু লিখার আগে পটভূমি হিসাবে তৎকালীন সর্বভারতীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্যানভাসে কিছু বলা প্রয়োজন।
সিপাহী বিপ্লবের পর এদেশের স্বাধীনতাকামী
আলেম সমাজ বৃটিশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে শরীক হন। বৃটিশ তাড়িয়ে মুসলিম
রাজত্ব কায়েম করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। অন্যদিকে ইংরেজী শিক্ষিত মুসলমানরা
উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করতে শুরু করেন এবং অন্যকেও তা
করার পরামর্শ দেন। এ শ্রেণীর উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানদের সাথে সাধারণ মানুষের প্রায়
সংযোগ সংশ্রব ছিল না। তাঁদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, মননশীল লেখালেখি
উচ্চ পর্যায়ে প্রশংসিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি
করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষ তাঁদের ধ্যান ধারণার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থেকে
বঞ্চিত হয়। উচ্চ পর্যায়ের এই সব মুসলমানরা যেমন তাদের সুখ-দুঃখের সাথে পরিচিত হতে
পারেনি, তেমনি ভাবে সাধারণ মানুষও তাদের অভাব-অভিযোগের কথা উচ্চ পর্যায়ে নিবেদন
করার সুযোগ পায়নি। ফলে শাসক গোষ্ঠির কাছ থেকে তারা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও রক্তচক্ষু এবং
প্রতিবেশী হিন্দুদের কাছ থেকে ‘মুছলমানের ব্যাটা’, ‘ম্লেচ্ছ’, ‘যবন’ ইত্যাদি
ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ছাড়া আর কিছুই পায়নি। তদুপরি শাসক খৃস্টান ও তাদের দোসর হিন্দু
সমাজের প্রভাবে মুসলমান সমাজে কুসংস্কার ও বিকৃত চিন্তা চেতনা গড়ে উঠতে থাকে।
হিন্দু সমাজের বহু সামাজিক রীতিনীতি মুসলমান সমাজেও অনুপ্রবেশ করে। তাদের এ অসহনীয়
অবস্থা থেকে উদ্ধার করার মত তখন কোন সুহৃদ বান্ধব ছিল না বললেও চলে। দিশাহারা দিক
নির্দেশনা শূন্য মুসলিম সম্প্রদায় এ অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের ভাগ্যের লিখন বলেই ধরে
নেয়।
ইংরেজ লেখক উইলিয়াম হান্টার
তাঁর ‘দি ইণ্ডিয়ান মুসলমানস্’ গ্রন্থে তৎকালীন ভারতীয় মুসলমানদের দুরবস্থা
সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি প্রকাশিত পত্র ও কমিশনারের কাছে পেশকৃত আবেদন
পত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কলকাতা থেকে ফার্সী ভাষায় প্রকাশিত ‘দূরবীন’ পত্রিকায়
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে পত্রটি ছাপা হয়। ঐ পত্রে বলা হয়:
আমরা দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য
হচ্ছি যে, উচ্চ স্তরের বা নিম্নস্তরের সমস্ত চাকরী নকরী ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের হাত
থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ
করা হচ্ছে। সরকার সকল শ্রেণীর প্রজাকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য, তথাপি এখন এমন
সময় এসেছে যখন মুসলমানদের নাম আর সরকারী চাকুরীয়াদের তালিকায় প্রকাশিত হচ্ছে না।
কেবল তারাই চাকুরীর জায়গায় অপাংক্তেয় সাব্যস্ত হয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবন কমিশনারের
অফিসে চাকুরীতে কতিপয় লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, কিন্তু অফিসারটি সরকারী
গেজেটে কর্মখালির যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তাতে বলা হয়, এই শূন্য পদগুলিতে
কেবলমাত্র হিন্দুদেরই নিয়োগ করা হবে। মোট কথা মুসলমানদের এতটা নিচে ঠেলে দেয়া
হয়েছে। যে, সরকারী চাকুরীর জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা সত্তে¡ও সরকারী বিজ্ঞপ্তি মারফৎ এটা জানিয়ে দেয়া হচ্ছে,
তাদের জন্য কোন চাকুরী খালি নেই। তাদের অসহায় অবস্থার প্রতি কারো দৃষ্টি নেই এমনকি
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজী নন।
উড়িষ্যার মুসলমানদের পক্ষ থেকে
কমিশনারের কাছে পেশকৃত আবেদন পত্রের কিয়দংশ উইলিয়াম হান্টার তাঁর পুস্তকে উল্লেখ
করেছেন। উক্ত আবেদন পত্রে বলা হয়:
মহামান্য দয়াবতী রাণীর অনুগত
প্রজা হিসেবে দেশের সরকারী চাকুরীতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার আমাদেরও আছে বলে আমরা
বিশ্বাস করি। কিন্তু সত্যিকথা বলতে কি, উড়িষ্যার মুসলমানদের ক্রমাগত নীচে চেপে
রাখা হচ্ছে এবং তাদের মাথা তুলে দাঁড়াবার আর কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।
সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণকারী এই সব মুসলমান বর্তমানে চাকুরীর অভাবে দরিদ্র হয়ে
পড়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়ে তাদের অবস্থাটা ঠিক ডাঙ্গায় তোলা
মাছের মত করুণ। মুসলমানদের এই করুণ অবস্থার কথা আপনার সামনে এই আশায় তুলে ধরছি যে,
উড়িষ্যা বিভাগে মহামান্য রাণীর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে আপনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর প্রজার প্রতি সুবিচার করবেন। সরকারী চাকুরী থেকে বঞ্চিত
হবার কারণেই আমরা আজ কপর্দকহীন হয়ে পড়েছি। আমাদের অবস্থা আজ এতই শোচনীয় যে, আমরা
দুনিয়ার যে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে রাজী আছি, হিমালয়ের চুড়াই হোক কিংবা
সাইবেরিয়ার জনমানবহীন প্রান্তরেই হোক, যদি জানতে পারি যে, অনুরূপ ভ্রমণের ফলে
সপ্তাহে মাত্র দশ শিলিং বেতনের কোন চাকুরীতে আমাদের নিয়োগ করা হবে।
উল্লেখিত পত্র ও আবেদনপত্র
থেকে মুসলমানদের সামাজিক অবস্থার একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। মুসলমানদের
আর্থিক অবনতির কারণ সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
তাঁর মতে ১. সামরিক বিভাগ ২. রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা এবং ৩. বিচার বিভাগীয় অথবা
রাজনৈতিক ক্ষমতার সূত্র ধরে অভিজাত মুসলিম পরিবারে অর্থাগম হতো।
উইলিয়াম হান্টার আরো বলেছেন:
সূত্র গুলির প্রথমটা হচ্ছে
সেনাবাহিনী এবং সেখানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কোন
সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আমাদের কোন রেজিমেন্টে এখন আর প্রবেশ করতে পারে
না, এবং যদিও বা আমাদের সামরিক ব্যবস্থায় তাদের জন্য কদাচিৎ কোন জায়গা করে দেয়া হয়
তবু সেটা তার জন্য অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই সৃষ্টি করতে পারে না। পুরোনো
ব্যবস্থার ওপর যে প্রচন্ড আঘাতটা আমরা হেনেছি সেটা বোধ করি শঠতার পর্যায়েই পড়ে এবং
ইংরেজরা বা মুসলমানরা কেউই তখন এর পরিণতি উপলব্ধি করতে পারেনি। এটা হচ্ছে লর্ড
কর্নওয়ালিশ এবং জন শো’র প্রবর্তিত সংস্কার কার্যক্রম, ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তের মধ্যে যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে।
বিগত পঁচাত্তর বছরে বাংলার
অভিজাত মুসলমানদের জন্য সেনাবাহিনীতে প্রবেশের দরজা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি, কারণ
আমাদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে বাইরে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেছি। প্রশাসনের
সবচেয়ে লাভজনক জনকল্যাণ ও ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এটা করা প্রয়োজন বলে মনে করা
হয়েছে। কোম্পানীর ক্ষমতা লাভের একশ’ বছরের শেষ অর্ধাংশে স্রোতের গতি উল্টে যায়,
প্রথমে আস্তে আস্তে কিন্তু পরে অপেক্ষাকৃত তীব্রতর গতিতে।
এই সময় হিন্দুরা মঞ্চে প্রবেশ
করে এবং ক্রমান্বয়ে সকল স্তরের সরকারী চাকুরী সম্পূর্ণভাবে তাদের দখলে এসে যায়।
বৃটিশের অনুসৃত নীতির ফলে মুসলমানদেও অবস্থার এমনই অবনতি ঘটে যা উইলিয়াম হান্টারের
ভাষায়:
একশ’ সত্তর বছর আগে বাংলার কোন
সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানের দরিদ্র হয়ে পড়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার
কিন্তু বর্তমানে তার পক্ষে ধনী হওয়াটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
উইলিয়াম হান্টার আরো লিখেছেন:
এটা অবশ্য স্বীকার্য যে,
উচ্চতম অফিসার থেকে নিম্নতর স্তরের সকল সরকারী কর্মচারীর (বর্তমান ভাইসরয়ের মত আর
কেউ মুসলমানদের অসন্তোষের কারণগুলোর এতটা গভীরে প্রবেশ করেনি) এখন এই দৃঢ় বিশ্বাস
জন্মেছে যে, মহামান্য রাণীর মুসলমান প্রজাদের প্রতি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে
ব্যর্থ হয়েছি। ভারতীয় জনসমষ্টির একটা বিরাট অংশ, যাদের সংখ্যা তিন কোটির মত হবে,
বৃটিশ শাসনে নিজেদের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, মাত্র গতকালই যে দেশে তারা
ছিল বিজেতা ও শাসক, আজ সে দেশেই ভরণ পোষনের যাবতীয় সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের
অবস্থার অবনতি সংক্রান্ত এই সব অভিযোগের জবাব নীতিগতভাবে মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল,
কেননা তাদের প্রতি আমাদের উপেক্ষা এবং রাজনৈতিক অজ্ঞতাই অন্যতম কারণ। এদেশে শাসন
কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত হওয়ার আগে মুসলমানরা এখনকার মত একই ধর্মীয় মতবাদ প্রচার
করেছে আজ অবধি কিছুদিন পর পরই তারা পুরোনো জাতীয় চেতনার অভিব্যক্তি ও যুদ্ধংদেহী
মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে, কিন্তু বৃটিশ শাসনে আর সব ব্যাপারেই তারা জাতি
হিসেবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
উইলিয়াম হান্টার একজন বিদেশী
লোক। এদেশের মুসলমানদের অবনতির ব্যাপারে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি আজ পর্যন্ত
দৃষ্টান্ত হিসেবে গৃহীত হয়ে আসছে। মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি বৃটিশ
সরকারের কাছে ওকালতি করার স্বার্থে এ ধরনের মন্তব্য করেননি। বাস্তব অবস্থাকে
জনসমক্ষে তুলে ধরার মানসেই তিনি নিরপেক্ষভাবে সবকিছু বিচার করে তৎকালীন ভারতের
সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন।
সত্যাশ্রয়ী মনোভাবের জন্য উইলিয়াম হান্টার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
বৃটিশ আমলে বাবু ও ভদ্রলোক
বলতে বুঝানো হতো হিন্দুদের। অপরদিকে ‘চাষা’ ‘যবন’ ম্লেচ্ছ ইত্যাদি তুচ্ছার্থে
আখ্যায়িত করা হতো মুসলমানদের। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’
পুস্তকে ‘বাবু’ দের স্বরূপ ও স্বভাব সম্পর্কে বলেছেন:
এই সময়ে শহরের সম্পন্ন
মধ্যবিত্ত ভদ্র গৃহস্থদিগের গৃহে ‘বাবু’
নামে একশ্রেণীর মানুষ দেখা দিয়াছিল। তাহারা পারসী ও স্বল্প ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে
প্রাচীন ধর্মে আস্থাহীন হইয়া ভোগসুখেই দিন কাটাইত। মুখের পার্শ্বে ও নেত্রকোণে নৈশ
অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ কালিমা রেখা, শিরে তরঙ্গায়িত বাবরী চুল, দাঁতে মিশি,
পরিধানে ফিনফিনে কালোপেড়ে ধুতি, অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে
উত্তম রূপে চুনট করা উড়নী ও পায়ে পুরু বঙ্গলস সম্বলিত চিনে বাড়ীর জুতা। এই বাবুরা
দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ, বীণা প্রভৃতি
বাঁজাইয়া কবি, হাফ আখড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া রাতে বারাঙ্গনাদের আলয়ে গীত
বাদ্য ও আমোদ করিয়া কাটাইত।
[উৎসঃ আব্দুল মওদুদ: মধ্যবিত্ত
সমাজের বিকাশ: সংস্কৃতির রূপান্তর।]
এই ‘বাবু’ শ্রেণী লোকদের সাথে
মুসলমানদের কি সম্পর্ক ছিল তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন:
আর মিথ্যা কথা বলিবার প্রয়োজন
নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে।
আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ। আমরা বহু শত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া
এক ক্ষেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি, আমরা এক ভাষায় কথা
কই, আমরা একই সুখ-দুঃখের মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ
মনুষ্যেচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোন মতেই
ক্ষমা করিতে পারেন না। আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাসে
হিন্দু-মুসলমানে বসে না- ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়। হুকার
জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।
[উৎসঃ রবীন্দ্র রচনাবলী: আবদুল মওদুদ: মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ: সংস্কৃতির রূপান্তর
।]
ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক
অবস্থা এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে জানার জন্য উপরোক্ত উদ্ধৃতি যথেষ্ট বলে মনে
করা যায়। এ সম্পর্কে অধিক বলা নিষ্প্রেয়োজন। তখন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খৃষ্টান
প্রভৃতি ধর্মের প্রভাবে মুসলমানদেও ধর্মীয় চিন্তাধারায়ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার
করে।
উপমহাদেশের মুসলমানদের এই
ক্রমাবনতি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার
প্রেক্ষাপটেই মরহুম আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের জীবন ও কর্মকে বিচার করতে হবে।
মুসলমানদের চির দুশমন ইংরেজ
এবং আত্মকেন্দ্রিক হঠাৎ গজিয়ে উঠা এক শ্রেণীর অজ্ঞাত কুলশীল হিন্দু সম্প্রদায়ের
উচ্চাকাংখায় জেগে উঠা নীতির শোষণ পেষণ বঞ্চনা অবহেলা ও উৎপীড়নের যাতাকালে যখন গোটা
মুসলিম সমাজটিই শৃংখলিত, জবাই করা মোরগের মতো ডানা ঝাপটাচ্ছিল সেই যুগ সন্ধিক্ষণে
এই হতভাগা সমাজের উৎকণ্ঠা ও ব্যকুলতাকে ধারন করেই আবু আহমদ আবদুল হাফিজের জন্ম।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ২ জুন সিলেট
শহরের রায়নগর মহল্লায় আবু আহমদ আবদুল হাফিজ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন
স্বনামধন্য অবসরপ্রাপ্ত মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) খান বাহাদুর আবদুর রহিম। মাতা
হাফিজা খাতুন। হাফিজা খাতুন সিলেট শহরের পাঠানটুলার আসাম ও সাবেক পূর্ব
পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ বি.এল (১৮৮৬-১৯৬০)-এর বড় বোন। ‘সিলেটের
মহসীন’ হিসেবে খ্যাত মৌলভী আব্দুল করিমের ভাতিজি।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে আবু আহমদ
আব্দুল হাফিজ সিলেট সরকারী স্কুল থেকে মেট্রিক এবং ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে এমসি কলেজ
থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রাবস্থায় খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে
অংশগ্রহণ করে সাময়িকভাবে লেখাপড়া ত্যাগ করেন। তাঁর পিতা তখন আসামের নওয়াগায়ে
চাকুরীরত। বাধ্য হয়ে তাঁকে তার মামা রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক আবদুল হাকিম কোরেশীর তত্ত্বাবধানে
পাঠিয়ে দেন এবং আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ঐ কলেজ থেকে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ পাশ
করেন। তিনি ১৯২৪ খ্রিষ্টব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আরবীতে এম. এ এবং ১৯২৬
খ্রিষ্টাব্দে বি.এল পাশ করেন। শিক্ষা জীবন শেষে তিনি কিছুদিন সিলেট গভর্ণমেন্ট
হাইস্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে অক্টোবর মাসে তিনি সিলেট জেলা বারে
যোগদান করে ওকালতী শুরু করেন।
কলিকাতায় ছাত্রাবস্থায়ই তিনি
সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হন। তাঁর শিক্ষক স্যার আব্দুল্লাহ
সোহরাওয়ার্দী, নানা সিলেটের কৃতি সন্তান শিক্ষাবিদ মৌলভী আব্দুল করিম, স্যার আবদুর
রহিম, তাঁর পিতার সহপাঠি শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
প্রমুখের ঘনিষ্ট সংস্পর্শে আসেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় কলিকাতা সুরমা ভেলী মুসলিম
ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং কলিকাতার শ্রীহট্ট সম্মিলনীর ছাত্র পরিষদের
সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের ফেলো নিযুক্ত
হওয়ায় আরো ঘনিষ্ট হবার সুযোগ পান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শ্যামা প্রসাদ
মুখার্জী, স্যার আজিজুল হক, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় প্রমুখ দেশ বরণ্যে নেতৃবৃন্দের
সঙ্গে।
পেশা জীবনের শুরুতেই তিনি
রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন এবং মুসলিম সমাজের জন্যে নিজকে উৎসর্গ করেন। ১৯২৭
খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিলেট জেলা তবলীগ ও তানজিম কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং
কমিটির শাখা হিসাবে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ে একটি মিশন প্রেরণ করেন। এছাড়া বালাগঞ্জ
থানার আরংগপুরে একটি জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে গঠন করেন। এই মিশনের
নেতৃত্বদেন সৈয়দ ইয়াত্তর বখত, মাওলানা সখাওয়াতুল আম্বিয়া, ডাঃ মর্তুজা চৌধুরী,
মাওলানা আব্দুর রহমান সিংকাপনী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তিনি নিখিল ভারত তবলীগ কমিটির
আসাম শাখার সম্পাদক এবং ‘খাদিম উল ইনসান’ সমিতির সিলেট শাখার সম্পাদক ছিলেন। তিনি
সিলেটের ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহ এবং মানিক পীর (রহঃ)’র টিলার ম্যানেজিং কমিটিতে
দীর্ঘকাল জড়িত ছিলেন।
সিলেট জেলা মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় কর্মবীর আবু আহমদ আবদুল হাফিজের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগে যোগদান করে। এ সংগঠনকে গণমুখী করার জন্য সীমাহীন শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেন। এ ব্যাপারে তার মামা আবদুল হামিদ মিনিষ্টার, খান বাহাদুর মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী মিনিষ্টার, সুনামগঞ্জের মিনিষ্টার মুনাওর আলী, মিনিষ্টার আবদুল মতিন চৌধুরী, হাজী উসমান মিয়া মার্চেন্ট, হাজী ওয়াছিফ উল্লাহ প্রমুখ জননেতার সহযোগিতা ছিল। ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ পূর্ব পর্যন্ত এই নিঃস্বার্থ কর্মবীর সিলেট জেলা মুসলিম লীগের কখনো সম্পাদক, কখনো সভাপতি ছিলেন। তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল ছাত্রদের সঙ্গে। চল্লিশ দশকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে তার বাড়ী ছিল ছাত্রদের মিলন মেলা। এম. সি কলেজে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের অভাব ছাত্ররা তাঁর আসরে পুরন করতেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিলেট জেলা মুসলিম লীগের রেফারেন্ডাম বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সিলেটের গণভোটে এ বোর্ডই নেতৃত্ব দেয়। জননেতা আবদুল মতিন চৌধুরী এই বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। দেশ বিভাগকালে সিলেটের উলামাদের একদল জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কংগ্রেসের অনুসারী ছিলেন। তাঁরা ছিলেন অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। তাদের প্রভাবে সাধারণ মুসলিম জনসাধারণ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। এ জন্য মৌলানা সহুল উসমানীকে বিহার থেকে সিলেটে আনা হয়। আল্লাহর রহমতে তাঁর ওয়াজ ও ফতোয়ার জজবায় সিলেটের মুসলমানরা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানি’ আওয়াজ তুলে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জননেতা আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ সিলেটের পক্ষে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের সীমানা কমিশনের অন্যতম কৌসুলির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনে মরহুম আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন নেতৃত্বের ভুমিকায়। বাংলা ভাষার দাবীতে গোবিন্দ পার্ক (বর্তমান হাসান মার্কেট) সভার উপর হামলা হলে তারই উদ্যোগে সিলেটের আঠারো জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষার দাবীতে সিলেটের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসমাবেশে ৫ই মার্চ গোবিন্দ পার্কের সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মরহুম আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ মুসলিম লীগের কাজকর্ম থেকে সরে দাড়ান। পরবর্তীকালে রাজনীতিতে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিলনা বললেও চলে। শিক্ষা ও সমাজ সেবায় তাঁর পরবর্তী জীবন ছিল নিবেদিত।
তিনি দীর্ঘকাল রেডক্রস ও সিলেট
মাতৃমঙ্গল সমিতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সিলেটে প্রসূতিগার প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিশেষ
অবদান ছিল। তারই তত্ত্বাবধানে বর্তমান শহীদ সোলেমান হলের (সাবেক জিন্নাহ হল)
প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি সমবায় আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন। তিনি সিলেট সমবায় কেন্দ্রীয়
ব্যাংক লিমিটেডের সম্পাদক, সিলেট সমবায় টাউন ব্যাংকের সভাপতি, সুরমা ভেলী মুসলিম
কো-অপারেটিভ জুট মার্কেটিং সোসাইটির মেম্বার ছিলেন। তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে
করাচীতে সমবায় সেমিনারে যোগ দেন। দীর্ঘ ৩০ বৎসরের বেশী সময়কাল তিনি ডাক বিভাগ
ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি জিলা বার সমিতির সম্পাদক ও সভাপতির পদ দীর্ঘকাল
অলংকৃত করেন।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচ বছর
মেয়াদে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম সিনেটর হিসাবে মনোনীত হন। দেশ
বিভাগের পর ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের সভ্য নিযুক্ত হন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর এর প্রথম একাডেমিক কাউন্সিলের সভ্য ছিলেন।
পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিষদের সদস্য ও পরীক্ষক ছিলেন। তিনি
কুমিল্লা বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর বোর্ডের সিলেকশন কমিটির মেম্বার ছিলেন।
তাঁর উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় তাঁর
দাদীর নামে রায়নগর বখতিয়ার বিবি বালিকা বিদ্যালয় ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়।
দীর্ঘকাল তিনি এ স্কুলের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে জগন্নাথপুর থানার পাইল
গাঁয়ের জমিদার ব্রজেন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর উদ্যোগে সিলেট মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিতা
সহযোগী ছিলেন অধ্যাপক শশী মোহন চক্রবর্তী, অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রী, সিতাংশু
শেখর দাস এবং সিলেটের মুসলিম সমাজ থেকে এডভোকেট আবু আহমদ আবদুল হাফিজ। কলেজটির
প্রতিষ্ঠা কাল হতে তিনি গবর্ণিংবডির সদস্য হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে দেশ
বিভাগের ফলে ছাত্রী ও অধ্যাপকের সংখ্যা অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে চলে আসায় কলেজটি
বিপর্যয়ের মুখোমুখী হয়। এই দুর্যোগময় সময়ে কলেজটি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় তিনি
কলেজের অবৈতনিক অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেন। তিনি দীর্ঘদিন মদন মোহন কলেজের
গবর্ণিংবডির মেম্বার ছিলেন। মদন মোহন কলেজের দুর্দিনেও তিনি অবৈতনিক অধ্যাপকের
দায়িত্ব পালন করেন। কাজী জালাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসাবে তার
প্রচেষ্টায় স্কুলটিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। তিনি তাঁর নানির নামে
প্রতিষ্ঠা করেন আয়েশা এম.ই মাদ্রাসা ও গাভুরটেকি স্কুল (বালাগঞ্জ) ও কাজিটুলা
মাদ্রাসার সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল মডেল হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদক
ছিলেন। সিলেটের প্রায় প্রতিটি স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন।
এমসি কলেজ, সিলেট সরকারী হাইস্কুল, সিলেট সরকারী বালিকা বিদ্যালয়, এইডেড হাইস্কুল,
সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। সিলেটে একটি
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি শুরু থেকে জড়িত ছিলেন। শিক্ষা উন্নয়নে
বিশেষ করে চল্লিশের দশকে এবং ষাটের দশকের শুরুতে তিনি সিলেটের সফল নেতৃত্বের
ভূমিকা পালন করেন।
সিলেটে একটি ল কলেজ প্রতিষ্ঠার
উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তাঁকে ল কলেজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে
সিলেট ল’ কলেজ স্থাপনে তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সিলেট ল’
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। বয়োবৃদ্ধির জন্য তিনি এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি
চান, কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষকের চাপে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ব্যবস্থায় বৃদ্ধ
বয়সে তিনি ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। কলেজটির
দীনদশা থেকে বর্তমান অবস্থানে উত্তরনে তিনি এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরা ইতিবাচক
ভূমিকা পালন করেন। সিলেট ল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে হাফিজ পরিবারের শ্রম ও আর্থিক
অনুদান উল্লেখযোগ্য। এ কারণে সিলেট ল কলেজে আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ-এর নামে একটি
হলের নামকরণ করা হয়েছে।
কর্মবীর আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে জগন্নাথপুর থানার সৈয়দপুর গ্রামের জমিদার সৈয়দ আবুল বাশার
চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ কন্যা মরমী কবি সৈয়দ আশহর আলী চৌধুরীর নাতনী সৈয়দা শাহার বানুর
সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সৈয়দা শাহার বানু রাজনীতি ও সিলেটের সমাজ কল্যাণ মুলক
কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনিও সিলেটে মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিলেট মুসলিম মহিলা লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন।
১৯৪৭- এর সিলেটের ঐতিহাসিক রেফারেন্ডামের সময় তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে মুসলমান মহিলাদের
সংগঠিত করেন। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর সিলেট মহিলা কলেজের ছাত্রী সংগ্রহের জন্যও
দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের প্রতিবাদে তিনি জোবায়দা রহিম চৌধুরী, সৈয়দা
লুৎফুন্নেসা, সৈয়দা নজিবুন্নেচ্ছা সহযোগে সরদার আব্দুর রব নিশতারের কাছে প্রতিবাদ
লিপি পেশ করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা ছিল সক্রিয় এবং
১৯৫২তেও তারা সে ঐতিহ্য অব্যাহত রাখেন। তিনি সিলেট চালি বন্দর বালিকা বিদ্যালয় এবং
সিলেট মহিলা সমিতির সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ২১ অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল
করায় হাফিজ সাহেব সাথী হারা হয়ে নিংসঙ্গ জীবন যাপন করেন।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ৯ ফেব্রুয়ারী
পরিণত বয়সে রাজনীবিদ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী কর্মবীর আবু আহমদ আবদুল হাফিজ
ইন্তেকাল করেন।
মরহুম আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ
তথাকথিত পেশাদার বুদ্ধিজীবী, সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদ অথবা জীবিকান্বেষী
বিবৃতিবাজ ছিলেন না। তাঁর সমাজসেবার পেছনে কোন ধরনের লাভলোভ প্রত্যাশা প্রাপ্তিরও
মোহ ছিলনা। খালিস নিয়তে তিনি কওম ও জাতির সেবা করেছেন। এমনি ধরনের কওম ও জাতির
খেদমতগার কোন দেশে কোন সমাজে গণ্ডায় গণ্ডায় জন্ম গ্রহণ করে না। এখানেই তিনি অনেকের
মাঝে অনন্য।
চীনদেশের লোকদের সম্পর্কে একটি
প্রবাদ আছে, চীনারা জাতীয় ইতিহাস জানার আগে তাদের পিতৃপুরুষের ইতিহাস জেনে নেয়।
আমরা জাতি হিসেবে ঐতিহাসিক হলেও স্বীয় ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে গাফিল ও বেখেয়াল।
ঘরের চেয়ে পরের খবর রাখতে হয়রান পেরেশান। তাইত কর্মবীর আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এর
মত গুণীজনরা বিস্মৃত ইতিহাসের অন্তরালে ঠাই নিয়েছেন।
আজকে আমরা একটি স্বাধীন
সার্বভৌম দেশের গর্বিত সন্তান। এর পেছনে রয়েছে আব্দুল হাফিজের মতো কর্মীবীরদের
সীমাহীন শ্রম ও ত্যাগ।
হাল আমলে একদল বুদ্ধিজীবী ও
বিবৃতিবাজ খেতাবধারীদের সাতচল্লিশের ভারত বিভক্তিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার নিয়তে
'সাম্প্রদায়িক' বোলচালে আহাজারী করতে দেখা যায়। খুব সম্ভব তাদের উদ্দেশ্য- আমাদের
আবার এক দেহে লীন’ করে দেয়া। আফসোস, এরা কিন্তু একটিবার নিজের চেহারাটি আয়নার
সামনে দাড়িয়ে দেখতে নারাজ। কথার মারপ্যাচে মানুষ যতটা কপটতা ও প্রতারণার আশ্রয়
নিতে পারে বাস্তবে তা হবার নয়। এরা আয়নার সামনে দাড়ালে প্রতিবিম্বিত চেহারায় দেখতে
পেতো অবিভক্ত উপ-মহাদেশে আজকের যে বাংলাদেশে তাদের বসবাস তা ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের
অন্তর্ভূক্ত না হলে ঐসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের স্থান হতো হালের বলদের পেছনে। কলম
নয় পাচন হাতেই তাদেরকে হিন্দুস্থানের বর্ণহিন্দুদের ফাই-ফরমাস খেটে জিন্দেগী যাপন
করতে হতো। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগ না হলে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হত না। যদি
ধরে নেয়া যায় হতো, তাহলে সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশ কি এক হতো? হতো না। সুতরাং
এটা যারা মানতে চায়না তারা শুধু ইতিহাসের বাস্তবতাকেই অস্বীকার করে না-
প্রকারান্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করে।
উল্লেখ্য, বাঙালার মুসলমান
যুক্তবাংলার উদ্যোগ নেয়। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এতে সমর্থনও দেন।
কংগ্রেসের গোয়ার্তুমি এবং হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপে এই উদ্যোগ
ব্যর্থ হয়। তখন মুসলিম বাংলা পাকিস্তানভুক্তির কোশিশ করে। বাংলাদেশে মুসলমান যেমন
তাদের মুসলিম তহজীব তমদ্দুন সংরক্ষণ ও বিকাশে আগ্রহী তেমনি তাদের বাংলাদেশী
স্বকীয়তা-ভাষা ও কৃষ্টি সংরক্ষণেও প্রয়াসী। পাকিস্তানে এই দুই আগ্রহের সমন্বয়
সম্ভব হলো না। তদুপরি পশ্চিম পাকিস্তান উপনিবেশিক শোষণ নীতি এবং সর্বশেষে সবলে
দখলদারি নীতি জারির প্রয়াস পায়। বাংলাদেশের মুসলমান তাদের মুসলিম পরিচিতি বিসর্জন
দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে নাই। তাদের ধর্মীয়, ভাষাভিত্তিক ও নৃতাত্ত্বিক
স্বকীয়তা বজায় রেখেই তারা তাদের জাতি গঠন করেছে। এই জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান
ভুক্তির অভিজ্ঞতা সবিশেষ ভূমিকা রাখে। এই ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করা যাবে না। এ
চেষ্টা একান্তই বৃথা।
মরহুম আব্দুল হাফিজ ছিলেন সহজ
সরল ও অমায়িক ব্যক্তিত্ব। পরোপকার ও সমাজসেবা ছিল তার নেশা। তিনি ছিলেন কওম ও জাতির
জন্য উৎসর্গীত মর্দে মোমেন। মরহুম আব্দুল হাফিজের পারিবারিক জীবন ছিল সুখের। বেগম
আব্দুল হাফিজও ছিলেন একজন সমাজ সচেতন আলোকিত মহিলা। তাঁরা তের জন পুত্র কন্যার জনক
জননী। তাঁদের ৭ পুত্র ও ৬ কন্যা সকলেই উচ্চ শিক্ষিত ও সমাজে সু- প্রতিষ্ঠিত।
No comments