ডিন ও কারা এর মতানুসারে বাছাই এবং চরিত্র নির্বাচনের কৌশলসমূহ
ডিন ও কারা এর মতানুসারে
বাছাই এবং চরিত্র নির্বাচনের কৌশলসমূহআলোকচিত্র: ‘দ্যা এপ্লিকেন্ট’ নাটকে ল্যাম চরিত্রে মো. এনামুল হাসান কাওছার
TRYOUT AND CASTING (বাছাই ও চরিত্র নির্বাচন)
নাটক নির্বাচনের পর প্রত্যেক অভিনেতৃকে
পাণ্ডুলিপি প্রদান করতে হবে যাতে করে অভিনেতৃরা যথেষ্ট সময় নিয়ে পাণ্ডুলিপি পড়তে
পারে। এই সময় নির্দেশক তাঁদেরকে ব্যক্তিগত সাক্ষাতকার বা সাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার
মাধ্যমে তাঁদের নির্বাচন করতে পারেন।
নির্বাচন প্রক্রিয়া
(TRYOUT PROCEDURE)
নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রধানত দুই প্রকার।
যথা:
১) ব্যক্তিগত নির্বাচন (Personal
interview method)
২) সাধারণ নির্বাচন (General
tryout method)
ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার গ্রহণ প্রক্রিয়া
(Personal interview method):
এই পদ্ধতিতে নির্দেশকের উচিত অভিনেতৃদের সাথে যথা সম্ভব সহজতর (Informal) ভাবে আচরণ করা, যাতে করে তিনি অভিনেতৃদের মাঝে প্রত্যেকটি চরিত্রের প্রতিফলন দেখতে পান। প্রথম সাক্ষাৎকারে নাটকের গল্প, চরিত্র, কাঠামো এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা হতে পারে। অভিনেতৃদের উচিত স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যেকটি বিষয়ের আলোচনার অংশ নেয়া। তারপর নির্দেশক তাঁদের যেকোন একটি চরিত্রের সংলাপ পড়তে বলতে পারেন। প্রথমবার পড়ার পর নির্দেশক তাঁদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপদেশ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
নির্দেশক একা একটি স্থানে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতে পারেন, যাতে অভিনেতৃরা সাবলীল এবং সহজভাবে থাকতে পারেন। অভিনেতৃবৃন্দ চলনের (Movement) বেলায় যেন যথাযথ সাবলীল থাকতে পারেন এবং মানসিক আবেগ প্রকাশ করতে পারেন সে দিকে খেয়াল রাখা উচিত। নাটকের নির্দিষ্ট চরিত্র অনুযায়ী নির্দেশক প্রত্যেক অভিনেতৃকে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুসারে তাঁদের নির্বাচন করবেন। এই প্রক্রিয়াটি অল্প সংখ্যক অভিনেতৃদের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ। অথবা সাধারণ নির্বাচনের পর এটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। পেশাদার নির্দেশকরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।
২) সাধারণ বাছাই প্রক্রিয়া
(General tryout method):
আঞ্চলিক থিয়েটার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
এ ধরনের বাছাই প্রক্রিয়ায় বাছাই করা হয়। নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য এই সাধারণ নির্বাচন
পদ্ধতিতে নির্বাচন করা হয়। প্রথমে নির্দেশক নিশ্চিত হন যে, সকল অভিনেতৃরা নাটকটি পড়েছেন।
যদি পাণ্ডুলিপি হাতের কাছে না থাকে তাহলে নির্দেশক সবাইকে নিয়ে একসাথে নাটকটি পড়বেন।
কিন্তু একজন অভিনেতৃ কেবল একটি চরিত্র যেন না পড়ে বরং, সবগুলো চরিত্র যাতে পড়ে সেদিকে
খেয়াল রাখতে হবে। প্রথম পাঠের সময় নির্দেশক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করবেন এবং
অভিনেতৃরা তাঁদের বিশ্লেষণী চিন্তা দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করবেন।
পাঠের পর নির্দেশক নাটকের কাঠামো, বিষয়,
চরিত্র নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করবেন। তারপর বিভিন্ন চরিত্রের স্কেচ তৈরী করে
অভিনেতৃদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করবেন। তিনি বিভিন্ন দৃশ্যের স্কেচ, ফ্লোর প্ল্যান,
কস্টিউম প্রভৃতি দেখাবেন; এতে অভিনেতৃদের উৎসাহ তৈরি হতে পারে।
অভিনেতৃদের মানসিক দূরত্ব দূর করার
জন্য তাঁদের দিয়ে নাটকের ভাবের উপর ভিত্তি করে গান গাওয়ানো যেতে পারে। সুরের তথা মিউজিকের
সাথে অভিনেতৃদের চলন (Movement) করানো যেতে পারে। এছাড়া, ইম্পোভাইজেশন করানো যেতে পারে।
লোকনাট্যের অভিনেতৃ বাছাইয়ের জন্য এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর।
একটা সাধারণ পরিবেশে অভিনেতৃকে একটি নির্দিষ্ট অংশ পড়তে বলা যেতে পারে। তবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল সংলাপ পড়তে হবে না। নির্দিষ্ট কিছু সংলাপ পড়লেই চলবে। নির্দেশকের উচিত প্রত্যেক অভিনেতৃকে প্রতিটি দৃশ্য পড়তে দেয়া। এতে করে নির্দেশক সহজেই নির্দিষ্ট চরিত্রের জন্য অভিনেতৃ খুঁজে পাবেন।
স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে
বাছাই (Casting the individual actor)
সাধারণভাবে বাছাই করার পর নির্দেশক
আরো কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে পারেন। যেমন-
১) শরীরিক প্রকাশ ভঙ্গি (Physical Appearance
in General)
২) বয়স (Age)
৩) বাচনিক ক্ষমতা ও শব্দচয়ন (Voice
quality and Diction)
৪) ছন্দ ও গতিবিধির ধারণা (Sense
of Movement and Rhythm)
এই চারটি বিষয় ছাড়াও আরো কতিপয় বিষয়ের
দিকে নির্দেশককে মনোযোগী হতে হবে। যেমন-
১) থিয়েটার সম্পর্কে পূর্ব ধারণা (Sense
of Theatre and Background)
২) সংবেদনশীলতা ও কল্পনাশক্তি
(Sensibility and Imagination)
৩) অভিনেতৃর দর্শক আকর্ষণ ও স্বর প্রক্ষেপনের
ক্ষমতা (Audience Appeal and Power of Projection)
৪) অভিনয়ের অভিজ্ঞতা (Acting Experience)
৫) ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য (Personal Tonality)
৬) বিভিন্ন ধরনের নাটকে অভিনয়ের সামর্থ্য
(Playing Ability for Kind and Style of Play)
১) থিয়েটার সম্পর্কে পূর্ব ধারণা
(Sense of theatre and background)
অভিনেতৃর থিয়েটার সম্পর্কে পূর্ব ধারণা
আছে কি না তা জানতে হবে। এর ফলে নির্দেশক অভিনেতৃর মানসিক সামর্থ্য ও নাটক সম্পর্কে
ধারণার ভিত্তিতে একটি প্রতিচিত্র অংকন করবেন। অভিনেতৃর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সামাজিক
পরিচয় এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। নাটক সম্পর্কে বুঝতে পারার ক্ষমতা এবং নাটকের চরিত্র
সম্পর্কে সাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও সংবেদনশীলতা তথা চরিত্রায়ন করার সক্ষমতা অনুযায়ী নির্দেশক
অভিনেতৃ নির্বাচন করবেন।
২) সংবেদনশীলতা ও কল্পনাশক্তি (Sensibility
and imagination):
অভিনেতৃ যখন নাটক পাঠ করেন তখন তার
কল্পনাশক্তি ও সংবেদনশীলতা কাজ করে। ফলে নির্দেশক তাঁকে বিভিন্ন সময় সঙ্গীতের সাথে
বা সঙ্গীত ছাড়া পেন্টমাইমিক ইম্পোভাইজেশন (Pantomimic Improvisations) করার সুযোগ
প্রদান করবেন। এতে অভিনেতৃর কল্পনা ও সংবেদনশীলতা কাজ করবে, যার মাধ্যমে নির্দেশক তাঁর
পছন্দ মত অভিনেতৃ খুঁজে নিবেন।
৩) অভিনেতৃর দর্শক আকর্ষণ ও স্বর
প্রক্ষেপনের ক্ষমতা (Audience appeal and power of projection):
একজন অভিনেতৃর স্বর প্রক্ষেপন এবং দর্শককে
আকর্ষন করা ক্ষমতা কেমন তা জানার জন্য নির্দেশককে যেসব বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখতে হবে
তা হলো-
বাহ্যিক ভাবে অভিনেতৃকে কেমন দেখায়,
কণ্ঠস্বর কেমন, বাচনিক ভঙ্গী কেমন, শব্দ চয়ন, সাবলীলতা, চলনে (Movement) ও নির্বাক
অভিনয়ে (Pantomimic Dramatization) নির্ভুলতা প্রভৃতি।
এক্ষেত্রে নির্দেশক নিজে দর্শক সারিতে
বসতে পারেন এবং নিজেকে দর্শকের স্থানে রেখে তথা দর্শকের প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টি নিয়ে
ভাবতে পারেন। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ন কারণ অভিনেতৃ সর্বদা তাঁর
চরিত্রের বাহিরে গিয়ে নতুন চরিত্র নির্মান করেন।
৪) অভিনয়ের অভিজ্ঞতা (Acting
experience):
যদি নির্দেশক অভিনেতৃকে মঞ্চে পূর্বে
অভিনয় করতে দেখে থাকেন তাহলে এটি অভিনেতৃ বাছাইয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কারণ নির্দেশক
অভিনেতৃকে যে চরিত্রে দিতে চাচ্ছেন তাঁর সাথে অভিনেতৃ মানানসই কিনা তা বিবেচনা করা
আবশ্যক। অভিনেতৃর অভিজ্ঞতা অনেক সময় মানসিক ও শারীরিক গুনাবলির চেয়েও বেশি কাজে লাগে।
৫) ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য
(Personal tonality):
অভিনেতৃর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ অবশ্যই
নির্দেশকের নজরে রাখতে হবে। নাটকের চরিত্রের সাথে অভিনেতৃর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য যদি
মিলে যায় তবে তা নাটকের জন্য খুবই উপকারি হবে। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বলতে বোঝায়-
সুপ্ত নমনীয়তা, কাঠিন্য, ব্যক্তিত্ব,
ভাবগাম্ভীর্য, বুদ্ধি প্রভৃতি। সেজন্য নির্দেশককে অবশ্যই অভিনেতৃর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য
সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
৬) বিভিন্ন ধরনের নাটকে অভিনয়ের
সামর্থ্য (Playing ability for kind and style of play)
ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অভিনেতৃকে কোন
বিশেষ ধরনের নাটক অভিনয়ের জন্য একেবারে ঠিক অবস্থানে রাখতে পারে কিন্তু নাটকে যা করতে
বলা হয়েছে সেই বিশেষ কৌশল (Technique) অভিনেতৃ নাও জানতে পারেন। ট্রাজেডি, কমেডি,
মেলোড্রামা, অ্যাবসার্ট এমন বিভিন্ন ধরনের নাটকে কাজ করার দক্ষতা থাকা একজন অভিনেতৃর
জন্য খুব জরুরি। এটি তাঁর কণ্ঠ, শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং তাঁর সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক
ধারণার সাথে সম্পৃক্ত।
যেমন- ট্রাজেডিতে অভিনয়ের জন্য উচ্চ
স্বর, ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ দরকার আবার কমেডির জন্য দরকার হাস্য রসাত্মক আচরণ।
তাই একজন নির্দেশক অভিনেতৃর বিভিন্ন
ধরনের নাটকে অভিনয়ের দক্ষতা দেখেই তাঁকে নাটকের জন্য নির্বাচন করবেন।
দলগত ভাবে নির্বাচন
(Casting the ensemble)
প্রত্যকে চরিত্রকে আলাদা আলাদা ভাবে
নির্বাচনের আগে নির্দেশকের উচিত দলগত ভাবে পুরো দলকে মঞ্চে ওঠানো। তারপর নির্দেশক দর্শক
আসনে গিয়ে দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবাইকে দেখবেন। অতঃপর তিনি তিনটি বিষয়ের উপর
গুরুত্ব প্রাদান করবেন।
১) বৈপরীত্যের প্রয়োজনীয়তা
(Necessity of Contrasts)
২) ঐক্যতা (Unity)
৩) পারস্পরিক সহযোগিতা (Individual
Cooperation)
১) বৈসাদৃশ্যের প্রয়োজনীয়তা
(Necessity of Contrasts):
প্রথমেই নির্দেশক সকল চরিত্রকে পাণ্ডলিপির
চাহিদা অনুযায়ী দৃশ্যমান করার চেষ্টা করবেন। তারপর তিনি অভিনেতৃদেরকে একক ভাবে তথা
একে অন্যের সাথে বা একের সাথে অন্যকে দ্বান্দিক ভাবে দাঁড় করাবেন। তিনি অভিনেতৃদের
শরীরের বৈপরীত্য বা কণ্ঠস্বরের বৈপরীত্য তৈরী করবেন। চরিত্রের বৈশিষ্ট্য গুলোকে সহজ
করে তোলার চেষ্টা করবেন। নাট্য ক্রিয়ার বৈপরীত্যের সাথে চরিত্রের বৈপরীত্য তৈরী করার
চেষ্টা করবেন।
০২) একতা (Unity):
নির্দেশক বৈপরীত্য তৈরির ক্ষেত্রে যেসব
বিষয়ের উপর নজর রাখবেন না সেসব বৈপরীত্য একতা আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্বাভাবিকভাবেই
উচ্চ স্বরে হাসির কোন দৃশ্য একটি ট্র্যাজিক নাটকে স্পষ্টতই স্থান পাবে না।
৩) পারস্পরিক সহযোগিতা
(Individual Cooperation):
নির্দেশক অভিনেতৃকে একক ভাবে অভিনয়
করার সাথে সাথে দলগত ভাবেও অভিনয় করার সুযোগ প্রদান করবেন। ফলে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য
মিলে একটি দলগত অভিন্ন বৈশিষ্ট্য আত্মপ্রকাশ করবে। আবার অনেক প্রতিভাবান অভিনেতৃ থাকেন
যারা নিজেদেরকে দলের অন্যান্যদের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন না। তাঁদের আবেগিক, মানসিক
ও শারীরিক সহযোগিতার বোধ জাগ্রত করা এবং সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন হয়। যখনই কোন নির্দেশক
দলীয়ভাবে কাজ করার কথা ভাবেন তখনই অভিনেতৃর এই যোগ্যতা ও সমগ্র কাজের সাথে একাত্ম
হবার যোগ্যতা ভাল ফলাফল বয়ে আনতে সহায়তা করে।
কৃতজ্ঞতা:
জনাব, কৃপাকণা তালুকদার
শিক্ষক
নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
লিখেছেন:
মো. এনামুল হাসান কাওছার
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
No comments