বাদামওয়ালার যুদ্ধ | গল্প
দিনের আলো নিভে গেলে শহরে সন্ধ্যা নামে। ব্যস্ত মানুষগুলোর ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ঘরমুখো হয় ফিরতে শুরু করে আপন ঠিকানায়। ঠিক সাতটা বাজে গলির মুখে আওয়াজ শুনা যায় "বাদাম, বাদাম, বাদাম কিনবেন, বাদাম।" প্রতিদিন এই শব্দগুলো শুনতে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত।
আমাদের বাসার পাশে একটা ছোট্ট ছাউনিতে থাকে সে। ঠিক ছাউনি না। শক্ত, মোটা কাপড় দিয়ে চারপাশ ঘেরা করা ছোট্ট ঘর। সাত বছর বয়সী একটি ছেলে ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নিয়েই তার সংসার।সারাদিন বাইরে বাদাম বিক্রি করে। রাতে বাসায় ফিরে। যা উপার্জন হয় তা দিয়েই সংসার চলে।
আমি আব্দুল্লাহ। সবেমাত্র সপ্তম শ্রেনীতে উঠলাম। লজিং থাকি আব্দুস সাত্তার সাহেবের বাসায়। প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো উনার বাসায় আসার। দিনের বেলা মাদ্রাসায় যাই। আর সন্ধ্যায় সাত্তার সাহেবের দুইছেলেকে আরবি পড়াই। মাদ্রাসার ছাত্রদের খুব খাতির করা হতো সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার গুলাতে।
সাত্তার সাহেবের সাথে প্রায়ই আড্ডা জমে উঠে। বিশেষ করে রাজনীতির আলাপ আলোচনা নিয়ে। আমি রাজনীতি না বুঝলেও সাত্তার সাহেবের কথা শুনে মজা পাইতাম। উনার কথায় সায় দিয়ে যেতাম।
উনার কথাগুলো ভালো লাগলেও মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো। কারন তিনি বাংলার চাইতে উর্দুতে বেশি কথা বলতেন। মাঝে মাঝে জোরে জোরে বলতে থাকেন জয় পাকিস্তান।
বাদামওয়ালার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হতো, কথা হতো। বাদামওয়ালার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সে দেশের কথা বলতো, আমাদের দেশ নাকি পাকিস্তানিরা দখল করে আছে৷ যুদ্ধের কথা বলতো, দেশে নাকি যুদ্ধ লাগবে। এসব কথা শুনে আমারও ভালো লাগতো। আমার খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো বাদামওয়ালার সাথে। তার কাছ থেকে প্রথম শুনেছিলাম দেশের স্বাধীনতার কথা। মানুষ নাকি যুদ্ধ করবে দেশের জন্য। এভাবেই চলছিলো দিন।
ঘটনাটি সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকের। তখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছে দেশে। এলাকা প্রায় জনমানবহীন। কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে আবার কেউ ভারতে চলে গেছে। যুবকদের মধ্যে প্রায় সবাই যুদ্ধে চলে গেছে। আজ কাল শুনছি বাদামওয়ালাও নাকি যুদ্ধে গেছে৷ সে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করে। যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ওই ডেরায়ই রয়ে গেছে। ভরসা ছিলো সাত্তার সাহেবকে ঘিরে।
আমি সারাদিন বাসায় বন্দী থাকি। ছোট মানুষ পরিবারের সবার সাথে থাকতে হয়৷ সাত্তার সাহেব বাইরে ঘুরে ফিরেন, মাঝে মাঝে বাসায় মেহমান নিয়ে আসেন। গায়ে সবার একই রঙের জামা, মাথায় টুপি। তার কাছে শুনেছিলাম ওরা নাকি পাকিস্তানি মিলিটারি। সাত্তার সাহেবের সাথে তাদের খুবই ভালো সম্পর্ক।
আমাদের চারতলা বাসার ছাদে তাদের আড্ডাখানা ছিলো। মাঝে মাঝে রাতের বেলা সবাই একসাথে আড্ডা দিতো।
সেদিন মাঝরাতে কিসের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে বসলাম। পর পর তিনটি গুলির আওয়াজ আসলো উপর থেকে। বুঝলাম ছাদে কিছু একটা হচ্ছে। লুকিয়ে দেখার জন্য চুপি চুপি ছাদে উঠলাম। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম কয়েকজনের লাশ পড়ে আছে ছাদের উপর। রক্তে লাল হয়ে আছে ছাদ। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সাত্তার সাহেব, সাথে কয়েকজন মিলিটারি । বাদামওয়ালার স্ত্রীকেও দেখতে পেলাম পাশে। কয়েকজন মিলিটারি তার কাপড় ধরে টানাটানি করছে। আমি ভয়ে থর থর করে কাঁপছিলাম।
একবার ভাবলাম দৌড়ে গিয়ে মিলিটারিদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেই তাকে। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেলেন তিনি। ধপাস করে আওয়াজ হলো। তার কাপড় এক মিলিটারির হাতে থেকে গেলো। একসাথে চলে গেলো দুটি প্রান। যে এখনো পৃথিবীর মুখ দেখেনি। সেও পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। আমি ভয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে আসলাম। সারারাত ঘুম হয় নি। ভয়ে ভয়ে বাকিরাতটুকু কেটে গেলো।
ভোররাতে কাউকে কিছু না বলে সাত্তার সাহেবের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলাম। কিন্তুমনের মধ্যে থেকে গেলো একধরনের অস্বস্তি। যুদ্ধ মানেই কি তাহলে প্রান দিয়ে দেওয়া। যে যুদ্ধের কথা বলেছিলো বাদামওয়ালা। তাহলে এটাই কি বাদামওয়ালার যুদ্ধ?
লেখক-
সাইদুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments