দেশ ও জীবন গঠনে লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল | বাংলাদেশে স্কাউটিং এবং সময়ের প্রত্যাশা
১৯২০ সালের ৬ আগস্ট জাম্বুরীর শেষ সন্ধ্যায় হর্ষোৎফুল্ল বিরাট বালক জনতা বিপিকে “বিশ্বের প্রধান স্কাউট” রুপে ঘোষণা করে। |
দেশ ও জীবন গঠনে লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল, বাংলাদেশ স্কাউটিং এবং সময়ের প্রত্যাশা
স্রষ্টার অশেষ কৃপা যে, আমরা মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছি। আর মানুষ হবার সুবাদে সৃষ্টির অধিকাংশ নিয়ামতকে কর্তৃত্বসহ উপভোগ করছি। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, এ পৃথিবীতে অনেকেই সঠিকভাবে বেঁচে নেই। অর্থাৎ, মানবিক মর্যাদা, মূল্যবোধ ও সুস্থ্যতা নিয়ে বেঁচে নেই। অনেকেই এত বেশী ক্লেশ নিয়ে দিন কাটাচ্ছি যে, এ যেন না মরে বেঁচে থাকা। কিন্তু মর্যাদাপূর্ণভাবে জন্ম নিয়ে সুস্থ্য-সুন্দর ভাবে জীবন উপভোগ করতে না পারার কারণ আমরা অনেকেই খুঁজে দেখিনা। অনেকে কপালের দোষ, সমাজের দোষ কিংবা অন্য কোন ব্যক্তি-বস্তু বা স্রষ্টার উপর দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চাই।
তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারেনা। সে কারণে এ পৃথিবীতে মানুষের মঙ্গল ও ধরিত্রির কল্যাণে কাজ করেছেন অনেকে। তাদের কেউ করেছেন আত্মিক উন্নয়নে, কেউ করেছেন ধন-রত্ন বৃদ্ধিতে, কেউ করেছেন জ্ঞান বিকাশে। এমন বহুবিধ উন্নয়নের পথিকৃতের মাঝে সফল জীবন গঠনের অনন্য পথিকৃৎ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল।
যিনি বিশ্ব স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা এবং যাকে বিপি নামে এক ডাকে বিশ্ব চেনে। তিনি শিশু দরদি, মানব দরদি, জীবন উন্নয়নের ক্যাপ্টেন এবং সুখী হওয়ার উপায় দাতা ও পরম বন্ধু।
বিপি ১৮৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী; নাম রেভারেন্ড এইচ.জি. ব্যাডেন পাওয়েল। মা ছিলেন ব্রিটিশ নৌ সেনাপতি ডব্লিউ.টি স্মিথের কণ্যা। বিপি’র নানা এ্যাডমিরাল উইলিয়াম স্মিথ ছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত ক্যাপ্টেন জন স্মিথের বংশধর। আমেরিকার ভার্জিনিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বিপির নানার ছিল বিশেষ অবদান ।
সুখের মাঝে জন্ম নিলেও মাত্র তিন বছর বয়সে বিপি পিতাকে হারান। সাত ভাই-বোনের মধ্যে বিপি ছিলেন পঞ্চম। পিতার মৃত্যুতে বিপির পরিবার আর্থিক অসুবিধায় পড়েন। কিন্তু মায়ের স্নেহে পাওয়েল ভ্রাতাগণ স্কাউট উপদলের মত কাজ করে জীবনকে আনন্দমুখর করে তোলেন। বিপি পরিণত বয়সে একজন বীর সেনা নায়ক হয়ে ছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিপি সাব-লেফটেনেন্ট হিসেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ভারতে আগমনের সুযোগ লাভ করেন। ফৌজি কাজে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তিনি ২৬ বছর বয়সে কাপ্তান (ক্যাপ্টেন) পদে উন্নীত হন।
বিপি ১৮৮৭ সালে আফ্রিকায় রণাভিযান পরিচালনা করেন। আফ্রিকার স্বদেশীয় জনগণ তার সাহস, স্কাউটিং নৈপুন্য এবং বিস্ময়কর চিহ্ন অনুসরণ শক্তি ও দক্ষতার জন্য তাঁকে এত বেশি ভয় করত যে তারা তার নাম দিয়েছিলেন “সদা জাগ্রত নেকড়ে বাঘ”।
১৮৯৯ সালে বিপি কর্ণেল পদে উন্নীত হয়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বিপি দক্ষিন আফ্রিকা হতে ইংল্যান্ডে ফিরলে ব্রিটিশ নাগরিকগণ এবং বালকদের কাছে তিনি এক মহান বীর রুপে প্রতিভাত হন।
বিপি ১৯০৭ সালে গ্রীষ্মকালে ইংলিশ চ্যানেলে অবস্থিত ব্রাউন-সী দ্বীপে বিশ জন বালকের একটি দল নিয়ে দুনিয়ার প্রথম বার স্কাউট শিবির আয়োজন করেন।
এরপরের বছর ১৯০৮ সালের গোড়ার দিকে ছয়টি পাক্ষিক খন্ডে তার শিক্ষা প্রণালী বিষয়ক কর্ম Scouting for Boys প্রকাশিত হয়। অতঃপর Scouting for Boys পত্রিকা ও বই বিপনীতে দেখা দিতে না দিতেই সর্বত্র স্কাউট দল ও উপদল গড়ে উঠতে থাকে এবং ১৯১০ সালে স্কাউটিং এত বিরাট আকার ধারণ করে যে বিপি বুঝতে পারেন স্কাউটের কাজই হবে তার জীবনের প্রধান কাজ। সে উপলব্ধি থেকে তিনি সম্মানজনক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এর পদ ইস্তফা দিয়ে স্কাউটিং এর মাধ্যমে দুনিয়ার সেবা করার জীবন শুরু করেন।
সামরিক জীবন থেকে মুক্ত হয়েই বিপি ১৯১২ সনে বিভিন্ন দেশের স্কাউটদের সহিত মিলিত হবার জন্য ভূ প্রদক্ষিণে বের হন। অতঃপর ১৯২০ সালে দুনিয়ার সকল স্কাউটিং এর সমন্বয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সমাবেশ প্রথম বিশ্ব জাম্বুরী লন্ডনে আয়োজন করেন। ৬ আগস্ট এই জাম্বুরীর শেষ সন্ধ্যায় হর্ষোৎফুল্ল বিরাট বালক জনতা বিপিকে “বিশ্বের প্রধান স্কাউট” রুপে ঘোষণা করে। এটা ছিল বিপির প্রাপ্য এবং যোগ্য সম্মান।
আমৃত্যু বিপি শিশুদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড় তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বুঝে ছিলেন
- স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালন
- সর্বদা অন্যকে সাহায্য করা
- আত্ম মর্যাদা নিয়ে বাঁচা ও বাঁচতে শেখা
- বিনয়ী ও অনুগত হওয়া
- সকল জীবের প্রতি সদয় থাকা
- প্রফুল্ল থাকা
- মিতব্যয়ী হওয়া এবং
- চিন্তা, কথা ও কাজে নির্মল থাকতে পারলে মানবজীবন সুন্দর হবে।
আর সেই সৌন্দর্য অর্জন ও উপভোগের জন্য শিশুকাল থেকে অভ্যাস করা, অনুশীলন করা এবং আত্মমর্যাদার সংগে প্রচেষ্টা গ্রহণ প্রত্যেক শিশুর কর্তব্য। এমনকি বড়দের জন্য প্রয়োজন। তিনি আরো বুঝেছিলেন, জীবনের সাফল্য পেতে হলে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই পেতে হবে।
বিপি জীবনের গভীরে গিয়ে অনুভব করেছিলেন, সুকোমল কেদারায় কিংবা পুষ্পসজ্জা দ্বারা মানবজীবন সার্থক করা সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বেচ্ছা সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী নন্দিত হয়েছেন এবং কোটি গৃহে, বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে সু সন্তান উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। যারা দেশপ্রেম, বন্ধুবাৎসল্য ও স্রষ্টার প্রতি গভীর অনুরাগ নিয়ে নিজেদেরকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন তেমনি পৃথিবীকে করেছেন আলোকিত-মহিমান্বিত।
লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল বাংলাদেশেও যুগান্তকারী কর্ম নেতা। সে কারণে স্কাউটিং এর সঙ্গে জড়িত মহামান্য রাষ্ট্রপতি হতে শুরু করে ক্ষুদে শিক্ষার্থীগণ পর্যন্ত, বিশেষ ভঙ্গিমা, পোষাক, ওয়াগল, স্কার্প,ব্যাজ, মেডেলে অলংকৃত স্কাউট, গার্ল গাইড, কাব ও রোভার গণকে সহজে চেনা যায়। মানবসেবা, দক্ষতা, সাহসিকতার জন্য ও স্কাউটগণকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়, সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়।
আজ চারদিকে লোভী মানুষ বহু আছে। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক তেমন নেই। কর্মকর্তা বহু আছেন কিন্তু সৃজনশীল, সাধু-স্বজন কর্মী আনুপাতিক হারে বেশি নেই। প্রচুর চাটুকার আছেন কিন্তু উপযুক্ত শিষ্য নেই। বিদ্বান আছেন কিন্তু, অতি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ কিভাবে সাশ্রয় করতে হবে সেটাও তাদের জানা নেই।
এমন বহু সংখ্যক ‘নেই’ কে ‘আছে’ তে রূপান্তর করার জন্য মানুষ গড়ার ছাঁচ বা ফর্মা একান্ত আবশ্যক হেতু স্কাউটিং এর কোন বিকল্প নেই।
সংকলনে-
মাহমুদুল হাসান মাসুদ।
No comments