দ্যা ডেইলি এজুখেইশনে বিজ্ঞাপন দিতে কল করুন

+88 01521 20 70 54 (Call for Ad)

অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন



অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন 

দুইহাজার একুশ সাল, বাংলাদেশ নামক ছোট্ট ভূখন্ডটি পঞ্চাশ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহন করেছে৷ যা "রূপকল্প-২১" বা "ভিশন-২১" নামে পরিচিত। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে কোন অবস্থানে দেখতে চাই, সেটিই মূলত রূপকল্প-২১ এর মূলকথা। রূপকল্প-২১ এর লক্ষ্যগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উদ্যোগ। যেখানে মোলিক চাহিদা, জনসংখ্যা ও শ্রমশক্তি উন্নয়ন, দারিদ্য বিমোচন, খাদ্য-পুষ্টি, শিল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি, এখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে। যে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন বাঙালী জাতির স্থপতি, বাংলাদেশের রূপকার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছেন। মূলত অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনই ছিলো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন।

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য যতটুকু না কথা বলেছেন তার থেকে বেশি তিনি মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্যে স্বাধীনতার কথা একবার উঠে আসলেও মুক্তির কথা কয়েকবার উঠে এসেছে। 

তার ভাষনে তিনি বলেছেন
"আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। " 
"এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মুক্তি পাবে। " 

তিনি এদেশের মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন, অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পাশাপাশি একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিলো গরিব, দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য লড়াই করা। তিনি ধনী গরিব বৈষম্য তাড়ানোর জন্য ছিলেন প্রতুশ্রুতিবদ্ধ, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ছিলেন নির্ভীক।  স্ব-নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হাতে নিয়েছিলেন নানা কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কার্যক্রমগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এনেছিলো আমূল পরিবর্তন। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পডেছিলো।  এই শোচনীয় অবস্থায় শক্ত হাতে হাল ধরেছিলন তিনি। দায়িত্ব কাধে নিয়ে নেমে পড়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে। তৈরি করলেন মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি বেশকিছুর কার্যকরী পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন দেশের কৃষিখাতকে ধরে রাখতে পারলে অর্থনীতিতে এর ধনাত্বক প্রভাব পাওয়া যাবে। কারন বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিলো কৃষি নির্ভির৷ দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষের জীবিকার মাধ্যম ছিলো কৃষি। জাতীয় আয়ের অর্ধেক এর বেশি আসতো কৃষি থেকে। তাই তিনি কৃষকদের বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য-

১) কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনাসহ পূর্বের সকল খাজনা মওকুফ করে দেন। 
২) একটি পরিবারের সর্বাধিক ১০০ বিঘা জমির মালিকানা নির্ধারন করেন। 
৩) বাইশ লাখের অধিক কৃষক পরিবারের পুনর্বাসন করেন। 
৪) গবেষণার জন্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও স্বল্পমূল্যে বীজ ও সার বিতরনের ব্যবস্থা করেন৷ 

এছাড়াও বঙ্গবন্ধু কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মসূচির ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন কৃষি খাতের উন্নয়নে৷ 

বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপগুলোকে উদ্দেশ্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন বলেছিলেন -
"জাতির জনকের স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম ছিলো কৃষি ভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কারণ তিনি মনে করতেন কৃষির উন্নয়ন ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে না। বঙ্গবন্ধু কৃষকের উন্নয়নে ও দেশের অর্থনীতি বেগবান করার লক্ষ্যে ব্যপক উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ঘরেফেরা কর্মসূচি ও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প চালু করা হয়েছে৷ একই গ্রামের কৃষকদের সেই প্রাচীন চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক চাষাবাদ চালু হয়েছে।"

সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে প্রয়োজন ছিলো সুচিন্তিত পরিকল্পনার। বঙ্গবন্ধুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সেটি আগেই অনুমান করেছিলেন। দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য শীর্ষ স্থানীয় সকল অর্থনীতিবিদদের নিয়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। যে কমিশন তৈরি করেছিলো প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭২-৭৬)। এই পরিকল্পনাই ছিলো স্বপ্ন পূরনের কার্যকরী পদক্ষেপ৷

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেছিলেন-
" বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন বিপর্যস্ত দেশের পুনর্গঠনে দরকার সুচিন্তিত পরিকল্পনার। এ কারনে দেশে ফিরে ১৮ দিনের মাথায় তিনি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। এ কমিশনে সেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছিলেন  যারা ছয়দফা, এগারো দফাসহ অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের সময় ভূমিকা রেখেছিলেন। এই কমিশন যুগান্তকারী প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলে। "

দেশের সম্পদ আহরণেরর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে দেশের মোট আয়ের ৬০% আসে এই প্রতিষ্ঠান থেকে।

স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু দেশে-বিদেশের সকল বাঙালি প্রতিভাবানদের আহবান করেছিলেন দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার জন্য। শিল্পকারখানাগুলোকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেশকিছু প্রতিষ্ঠান জাতীয়করন করেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য -

১) ব্যাংকসমূহ
২) সাধারন ও জীবনবীমা কোম্পানিসমূহ
৩) সকল পাটকল
৪) সকল বত্র ও সুতাকল 
৫) সকল চিনিকল ইত্যাদি। 

এছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পখাতে বিশেষ নজরদারি করেছিলেন। জোর দিয়েছিলেন ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। চা শিল্পের গবেষনার জন্য বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ইক্ষু গবেষণার জন্য ইক্ষু গবেষণা ইন্সটিটিউট ইত্যাদি। তিনি জানতেন গবেষনা ব্যতীত কোনো ফসলের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি " নিবিড় ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প ও খামার আধুনিকায়নের" মতো বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। ওষুধ শিল্পেও তার অবদান অনস্বীকার্য । দেশের পর্যটন শিল্পকেও বিবেচনায় নিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম কক্সবাজারে সৌন্দর্যমন্ডিত ঝাউগাছের সূচনা করেছিলেন, যা দেশে-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছিলো। শিল্পোন্নয়নের কার্যকরী সকল পদক্ষেপ অর্থনৈতিক মুক্তির উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেছিলো। 

শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ব্যাংকিং ও বীমাখাতে ব্যপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। যুদ্ধপরবর্তী কেন্দ্রীয়  ব্যাংক পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দেশের অন্যান্য ব্যাংকগুলো জাতীয়করনসহ সমবায় খাতে উন্নয়নের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের প্রতিটি গ্রামে সমবায় গড়ে উঠবে, প্রতিটি মানুষ আশ্রয় পাবে। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করবে, যৌথভাবে উৎপাদন কার্য সম্পাদন করতে পারবে। জোতদার ধনী চাষী থেকে মুক্তি পাবে। ১৯৭০ সালে একটি বেতার ভাষনে তিনি বলেছিলেন -

"ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে ব্যপকভাবে উৎসাহিত করতে হবে। কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তাঁতিদের নায্যমূল্যে সুতা ও কাপড় সরবরাহ করতে হবে। তাদের জন্য অবশ্যই বাজারজাতকরন ও ঋণসুবিধা দিতে হবে।" 
তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় গড়ে উঠে বাংলাদেশের জামানত বিহীন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান "ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন " বা (SFDF)। এইসকল পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যপক ভূমিকা রেখেছিলো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা ছোটকাল থেকেই ছিলো, যেমনটি রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিলো। তিনি গরিব- দুঃখী মানুষের ব্যথা উপলব্ধি করতে পারতেন৷ অসহায় মানুষদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। এমনকি নিজের গায়ের জামা, চাদর খুলে দিয়ে আসতেও কার্পণ্য করেন নি। গরিব শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য গড়ে তুলেছিলেন "মুসলিম সেবা সমিতি।" বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছিলো মূলত গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করা।

ছয়দফা আন্দোলন, গনঅভ্যুত্থান সহ বেশ কিছু আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তির জন্য লড়েছিলেন। সর্বোপরি, তিনি বাঙালীর মুক্তির লড়াই জীবনের বৃহদাংশ ব্যয় করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু গরিব দুঃখী মানুষের জন্য লড়াইয়ে ছিলেন সোচ্চার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি ও উপাচার্য বঙ্গবন্ধুকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের উপকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন -" বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ব্যবসা-বানিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের বীজ বপন করেছিলেন।" বর্তমান বাংলাদেশ হয়তো বঙ্গবন্ধুর রোপন করে যাওয়া সেই বীজের ফসল। 

অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ভুলে যাওয়ার মতো নয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছিলো দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে লড়াই করা,  গরিব-দুঃখী মানুষের সুখ সমৃদ্ধির জন্য এক গভীর মানবিক দর্শন। তিনিই রচনা করেছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ। যেই বীজের ফসল হবে জিডিপিতে আমাদের ব্যপক পরিবর্তন, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উত্তরণ, দরিদ্রতার হার হ্রাস,  রূপকল্প-২১ সহ অন্যান্য সকল উন্নয়ন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু যেই মুক্তির বীজ রোপন করে গিয়েছিলেন, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন তারই প্রতিনিধিত্ব করে।

লেখক-
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।   

No comments

Powered by Blogger.