বিশ্ব আতঙ্ক: করোনায় করনীয়
করোনায় করনীয় নিয়ে লিখেছেন মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ |
বিশ্ব আতঙ্ক: করোনায় করনীয়
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
সম্প্রতি বিশ্ব জুড়ে এক নতুন আতঙ্কের
নাম করোনা। সকলেই কম বেশি বিষয়টা নিয়ে আতঙ্কিত। প্রতিদিন এই রোগে আক্রান্তের
সংখ্যা ভয়ানক হারে বেড়েই চলছে। কিন্তু এখনও এই রোগের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিষেধক
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেনি। সেই সাথে চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা রকম গুজব
আর কুসংস্কার।
ইতিমধ্যে আমরা অনেকেই করোনা সম্পর্কে
বহু বিষয় জ্ঞাত। কিন্তু যখন এত সব গুজব আর কুসংস্কার ছড়াচ্ছে আর আশেপাশের সবাই তাই
করছে তখন আমরাও দ্বিধা -দ্বন্দ্বে পড়ে যাই।
আসল বিষয়টা কি?
এখন আমাদের করণীয় কি? আর কোনটা করা
যাবে না।
কোন সব কাজ থেকে নিজেদেরকে এবং
আশেপাশের সবাইকে দূরে রাখতে হবে।
আসুন তাহলে জেনে নিই করোনা কী?
করোনাভাইরাস (Coronavirus)
একটি
RNA
ভাইরাস।
করোনা শব্দটির অর্থ হল পুষ্পমাল্য বা পুষ্পমুকুট। করোনা ভাইরাস সর্বপ্রথম ১৯৬০
সালে আবিষ্কৃত হয় এবং সেটি মালোশিয়াতে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনা
ভাইরাসটি ছড়িয়ে পরে। উহান শহরে ভাইরাসটি সনাক্ত হয় ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে। করোনা ভাইরাসটি কোভিড-১৯ (COVID-19)
যা
নভেল করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত। এরা হলো একই শ্রেণীভুক্ত ভাইরাস যারা স্তন্যপায়ী
প্রাণী এবং পাখি আক্রান্ত করে। মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শ্বাসনালী সংক্রমণ
ঘটায়।
ভাইরাসের শ্রেণীবিন্যাস:
গ্রুপ: ৪র্থ গ্রুপ {(+) ssRNA}
বর্গ: নিদুভাইরাস
পরিবার: করোনাভাইরদা
উপপরিবার: করোনাভাইরিনা
গণ: আলফাকরোনাভাইরাস,
বেটাকরোনাভাইরাস, ডেল্টাকরোনাভাইরাস, গামাকরোনাভাইরাস।
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯, রোগটিকে
এখন বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনাভাইরাস এমন একটি
সংক্রামক ভাইরাস - যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। সারাবিশ্বে এরই মধ্যে
১৯৮ টির বেশি দেশে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস, বিশ্বব্যাপী প্রাণহানি হয়েছে অসংখ্য
মানুষের। WHO-
World Health Organisation করোনা
ভাইরাসকে প্যানডেমিক বা মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে ১১ মার্চ ২০২০ সালে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চারদিকে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে
হারহামেশাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন সম্ভব্য করোনা রোগীরা।
রোগের লক্ষণ কী?
করোনা ভাইরাসের ৭ টি লক্ষণ শনাক্ত
করা হয়েছে। রেসপিরেটরি লক্ষণ ছাড়াও স্বাভাবিক জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের
সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ।
তাহলে কি সর্দি -কাশি হলেই ভেবে
নেবেন আপনি কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত?
না ঠিক এমনটিও না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোন রকম উপসর্গ ছাড়াও টেস্ট
পজিটিভ হতে পারে। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই
শুরু হয় উপসর্গ দেখা দেয়, পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত রোগের
উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচদিন সময় নেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গিয়েছে যে,
এটি বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি মারাত্মক।
বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের কোনো ধরণের অসুস্থতা রয়েছে (অ্যাজমা, ডায়বেটিস,
হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ) তাদের মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীন থেকে
পাওয়া তথ্য যাচাই করে জানা যায় যে, এই রোগে নারীদের চেয়ে পুরুষের মৃত্যুর
সম্ভাবনা সামান্য বেশি।
আক্রান্ত ব্যক্তি যেন শ্বাস
প্রশ্বাসে সহায়তা পায় এবং তার দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেন ভাইরাসের
মোকাবেলা করতে পারে তা নিশ্চিত করা থাকে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য।
সংক্রমণ এড়াতে করণীয়ঃ
১. বার বার হাত ধুতে হবে (সাবান অথবা
সাবান জাতীয় দ্রব্য দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড
যাবৎ): বাইরে থেকে এসে, হাঁচি বা কাশির
পর, খাবার প্রস্তুত ও পরিবেশনের আগে, টয়লেট ব্যবহারের পর, অসুস্থ ব্যক্তির
পরিচর্যার পর, গবাদি পশু-পাখির যত্নের পর।
২. যেকোনো সর্দি–কাশি, জ্বর বা
অসুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত এক মিটার বা ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। অহেতুক
বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৩. কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন (কাশি
বা হাঁচি দেওয়ার সময় নাক, মুখ রুমাল বা টিস্যু, কনুই দিয়ে ঢাকুন।)
৪.
অতিরিক্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই অবস্থান করুন।
৫. আপনার যদি মনে হয় যে আপনি
সংক্রামিত, তাহলে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলুন।
৬. ভালো করে সেদ্ধ করে রান্না করা
খাবার গ্রহণ করুন।
৭. নিজেকে সারাক্ষণ হাইড্রেট রাখুন।
৮. লক্ষণগুলো দেখা দেয়া মাত্রই ওষুধ
খান এবং পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠতে দেবেন না।
৯. দিনে কিছুক্ষণ রোদে অবস্থান করুন।
১০. যথাযথ বিশ্রাম নিন।
১১. ভিড় থেকে দূরে থাকুন।
১২. যতটা পারেন অন্যান্যদেরকে সচেতন করুন।
১৩. প্রয়োজনে সরকারি হেল্প লাইনে ফোন দিয়ে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ
করুন।
যা করা যাবে না
১. অপরিষ্কার হাত দিয়ে নাক মুখ
স্পর্শ করা যাবে না।
২. ধোঁয়াটে এলাকা বা ধূমপান করা যাবে
না।
৩. রান্না না করা গোশত ও ডিম খাওয়া
যাবে না।
৪. সব রকমের কুসংস্কার মেনে বা
হুজুগে কোন কাজ করা যাবে না (থানকুনি পাতা খাওয়া, পানি পড়া, নারিকেল গাছে পানি
দেওয়া বা হোমিওপ্যাথি ওষুধ ইত্যাদি।)
৫. মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে।
৬. সব রকমের নিউজ যাচাই বাছাই ছাড়া
বিশ্বাস করা যাবে না।
৭. অহেতুক মাস্ক পরিধানের প্রয়োজন
নেই বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন।
৮. অহেতুক বেশি খাদ্য কিনে বাজারে
খাদ্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করা যাবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের
সংক্রমণ এড়াতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা
হয়েছে। গণজমায়েত এড়িয়ে চলা সহ নানা রকম সর্তকতা অবলম্বনের কথা বলা হচ্ছে
জোরালোভাবে। তাই দেশের ও জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে ও করোনা ভাইরাস যাতে
আক্রান্ত স্থান বা ব্যক্তি হতে ছড়াতে না পারে তাই ইতিমধ্যে কয়েকটি বাড়ি লকডাউন
ঘোষণা করা হয়, পাশাপাশি সেনাবাহিনী মোতায়ন করা হয়েছে পরিস্থিতি সামাল দিতে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ফেরত ছেলের
সংস্পর্শে এসে মারা গেলেন কিডনি রোগে আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। যেখানে সরকার
বাধ্যতামূলক করেছে বিদেশ থেকে ফিরলে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য। সেখানে
আমরা কতটুকু মানছি? কতটা আমরা সচেতন? আপনার সামান্য অসচেতনতাই কেড়ে নিতে পারে
আপনার-আমার বাবা-মা, ভাই-বোন এবং প্রিয়
মানুষগুলোকে। ঝরে পড়তে পারে অজস্র সম্ভাবনাময় প্রাণ।
আসুন নিজের পরিবার ও দেশকে রক্ষা
করার জন্য নিজে সচেতন হই এবং অন্যকে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করি। পরিশেষে মনে
রাখতে হবে,
করোনার প্রতিষেধক বাজারে নেই। তাই আমাদের শ্লোগান হওয়া উচিৎ-"প্রতিকার না হোক সচেতনতাই আসল প্রতিরোধ"।
যে যে যার যার অবস্থান থেকে সচেতন
হই, করোনা ভাইরাসের মত মহামারি রোগ থেকে মুক্তি লাভ করি।
লেখক-
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments