দ্যা ডেইলি এজুখেইশনে বিজ্ঞাপন দিতে কল করুন

+88 01521 20 70 54 (Call for Ad)

পূর্ববঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রিক বাগানবাড়ির নাট্যচর্চা । কাওছার


পূর্ববঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রিক বাগানবাড়ির নাট্যচর্চা

পূর্ববঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রিক বাগানবাড়ির নাট্যচর্চা

-
মো. এনামুল হাসান কাওছার
সূচিপত্র
০১ পূর্ববঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রিক বাগানবাড়ির নাট্যচর্চা
০২ আলোক চিত্রাবলি
০৩ টীকা
০৪ সংগৃহীত সংবাদ, পত্র, ডায়েরি
০৫ তথ্যসূত্র

পূর্ববঙ্গে থিয়েটার নিয়ে সবচেয়ে পুরনো সংবাদ পাওয়া যায় ১৮৫৭ সালে। তথ্য অপ্রতুলতা হেতু অনুমান করা হয় ষাটের দশক থেকে পূর্ববঙ্গে থিয়েটার চর্চা বিকশিত হয়েছিলো। আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির আদি রূপ যাত্রা। বিদেশিদের অনুকরণে প্রসেনিয়াম মঞ্চে ঢাকায় থিয়েটার চর্চা প্রসারের বহু আগে থেকেই ঢাকায় সংস্কৃতি ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল যাত্রা। নানাবিধ তথ্যের আলোকে পূর্ববঙ্গে থিয়েটার চর্চার উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হলো- ইংরেজদের থিয়েটার, বাগানবাড়ির থিয়েটার, সৌখিন নাট্যগোষ্ঠীর থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার, পেশাদারী থিয়েটার প্রভৃতি।
১৮৩১ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ধনাঢ্যদের পরিচালনায় নির্মিত সখের নাট্যশালাতেই থিয়েটার বিকশিত হয়েছিলো। পূর্ববঙ্গেও যে এই ধারা ছিল না তা নয়। কলকাতার মতো প্রবল না হলেও পূর্ববঙ্গের ঢাকায় নাটক চর্চায় নওয়াব পরিবারের একটা বড় অবদান ছিল।
‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ [১.০৯.১৮৭৩, ১৫.১১.১৮৭৩ সংগৃহীত সংবাদ অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-১৮, ১৯ ] সূত্রে কুমারখালীতে ১৮৭৩ সালে সীতাহরণ ও পাবনায় সাবিত্রী নাটিকা মঞ্চায়নের খবর জানা যায়। ‘বিদ্যোন্নাতি সাধিনী’ পত্রিকা সূত্রে ১৮৬৫ সালের ২১ ডিসেম্বর শেরপুরে মধুসূদন রচিত প্রহসন একেই কি বলে সভ্যতা অভিনয়ের তথ্য জানা যায়।
১৮৬৯ সালে ঢাকার ধনাঢ্য রাধামাধব চক্রবর্তীর উদ্যোগে এক্রামপুর পদ্মসার বাড়িতে অভিনীত হয়েছিলো পদ্মাবতীআবু হোসেন নাটক। আর্মেনীয়রা ছিলো ঢাকার ধনাঢ্য সম্প্রদায়। ঢাকার বালিয়াটি লেনে, জে. সি. বালিয়াটির বাড়িতে, পাট ব্যবসায়ী লাজারাস নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। বেঙ্গল টাইমস এর ১৮৯৪ সালের ১২ ডিসেম্বরের একটি সংবাদ সূত্রে জানা যায় (সংগৃহীত সংবাদ অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-১৯) স্থানীয় ক্রাউন থিয়েটার কোম্পানি দুদিন মঞ্চস্থ করেছিলো লায়লা-মজনু, রাজাবাহাদুর এবং মীরাবাঈ। একটি সূত্রে জানা যায় বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরী নিজ বাড়িতে মঞ্চস্থ করেছিলেন নাটক নরনারী। কিন্তু পূর্ববঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রিক বাগানবাড়ির নাট্যচর্চায় ঢাকার নবাব বাড়ির (চিত্র-১, ২, ৩, ১০) অবদান সর্বাগ্রে;  বিশেষ করে এঅঞ্চলে উর্দু নাটক রচনা ও মঞ্চায়নে তারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। শিল্প সংস্কৃতিতে তাদের প্রবল উৎসাহ ছিলো।
খাজা আলীমুল্লাহর (চিত্র-১১) আমলে ঢাকার খাজা পরিবারে নাচ-গান অনুপ্রবেশ করে। তাঁর সময় বিয়ে-শাদী ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে গায়ক-গায়িকা এবং বাইজীদের আনা হতো। নাওয়াব আবদুল গনি (চিত্র-১৩) (১৮১৩-১৮৯৬) ও নওয়াব আহসানুল্লাহর (চিত্র-৪) (১৮৪৬-১৯০১) সময়ে নিয়মিতভাবে আহসান মঞ্জিল (টীকা-১) দরবারে (চিত্র-৭), শাহবাগ দরবার হল (চিত্র-৯), দিলকুশাবাগে, কখনো কোন অনুষ্ঠান উৎসব পালা-পার্বণ, জন্মদিন, বিয়ে এমনকি খৎনা অনুষ্ঠানেও নাচ-গান হতো। দুই নওয়াবের আমলেই নাচ-গানের শিল্পীদের এস্টেট থেকে মাসিক বেতন-ভাতাদি দেওয়া হতো। এদেরকে লখনৌ, কানপুর, কলকাতা, বেনারস, পাটনা এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে পূর্ববঙ্গে নিয়ে আসা হতো। হাকিম হাবিবুর রহমানের তথ্যমতে নবাব পরিবারে সান্নিধ্য পাওয়া কয়েকজন বাঈজি (চিত্র-১২) হলেন- তিনবোন আন্নু বাঈ, গণ্নুবাই ও নওয়াবীন এবং আবেদী, পিয়ারী বেগম, আচ্ছী বেগম, ওয়াসু, বাতানী, জামুরাদ, হীরা, পান্না, ইমানী, আমিরজান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।  
১৮৭৬ সাল থেকে খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে নওয়াব আহসানুল্লাহ শাহবাগে যে মেলার আয়োজন করেন তাতে নিজ ব্যয়ে নৃত্য-গীত, ম্যাজিক ও ক্রীড়া কৌতুকের ব্যবস্থা করেছিলেন। নওয়াব আহসানুল্লাহ নিজেই একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। রাগ-রাগিনীতে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল এবং তিনি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। তিনি অসংখ্য ঠমুরি রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত নাত ঢাকায় মিলাদ মাহফিলে গাওয়া হতো। কুল্লিয়াতে শাহীন নামে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থে ফারসি, উর্দু গজল এবং হিন্দি গীত পাওয়া যায়। এদেশের ঐতিহ্যবাহী বসন্তোৎসব উপলক্ষে গাওয়া হোলি গানের তিনি বড় সমঝদার ছিলেন এবং নিজেও অনেক হোলি গান রচনা করেছেন।
অল ইন্ডিয়া মোহামেডান শিক্ষা সম্মেলন (শাহবাগ, ১৯০৫) প্রতিনিধিগণের সঙ্গে খাজা সলিমুল্লাহ দেশবাসীর মধ্যে সঙ্গীত প্রসারের জন্য নওয়াব আহসানুল্লাহ ঢাকা সঙ্গীত বিদ্যালয় পরিচালনার্থে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। পুত্র খাজা আতিকুল্লাহকে (চিত্র-৫)  গান-বাজনা শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং খাজা আতিকুল্লাহ নিজে বেহালা বাজাতেন। নওয়াব পরিবারের খাজা আতিকুল্লাহ একজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ছিলেন। তিনি অনেকগুলো রাগরাগিনী সৃষ্টি করেন।
খাজা পরিবারের অনেকেই ঢাকা এবং আশেপাশে অনুষ্ঠিত যাত্রানুষ্ঠান হয়তো উপভোগ করে থাকবেন এটা খুবই স্বাভাবিক কথা। সীতার বনবাস, রামাভিষেক, কৃষ্ণলীলা, চেতন্যলীলা এসব যাত্রাপালা উনিশ শতকে ঢাকায় মঞ্চস্থ হতো। যাত্রার ব্যাপারে নওয়াব পরিবারের জড়িত থাকার ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য না পাওয়া গেলেও নাটকের ক্ষেত্রে নওয়াব পরিবারের অনেকে নানাভাবে জড়িত ছিলেন।
ঢাকায় নাট্যচর্চার সূত্রপাত হয় উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে। সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ'- এর সংবাদ থেকে নাট্যাঙ্গনে ঢাকার নওয়াব খাজা আবদুল গনি ও নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহর ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়। ঢাকায় নাট্যচর্চা শুরু হয় ১৮৫০-এর দিকে অস্থানীয় ইংরেজ ও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে মুসলমানরা নাট্যচর্চার প্রতি অনুৎসাহিত ছিলেন। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীল দর্পণ’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় এবং মঞ্চস্থ হয়। ১৮৬২ থেকে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঢাকায় ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ (টীকা-৩) ‘পূর্ববঙ্গ নাট্যসমাজ’ নামে নাট্যমঞ্চ গড়ে ওঠে এবং ব্যবসায়িক ভিত্তিতে তা চালু হয়।
১৮৭৩ সালে কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় এসে তৎকালীন নাট্যশালা পূর্ববঙ্গ রঙ্গ ভূমিতে মাসাধিককাল ধরে নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। নাটকগুলো পরিচালনায় নওয়াব আব্দুল গনি তার নিজস্ব ব্যান্ড পার্টি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
সাপ্তহিক ঢাকা প্রকাশ এর ১২.৩.১৮৭৬, ১০.০৮.১৮৭৬ (সংগৃহীত সংবাদ অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-২০)  এবং বেঙ্গল টাইমস এর ১৮.০৩.১৮৭৬, ২২.৩.১৮৭৬ (সংগৃহীত সংবাদ অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-২১) প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায় ১৮৭৬ সালের মার্চে নওয়াব খাজা আবদুল গনির আমন্ত্রণে বোম্বে থেকে একটি পার্সি 'গান ও নাটকাভিনয় কোম্পানী’ ঢাকায় আসে। এই গোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে হিন্দি ভাষায় হিন্দুস্থানী উপন্যাসের গীতাভিনয় ‘ইন্দ্রসভা’ নাটক ও একটি প্রহসন মঞ্চস্থ করে। ঢাকা প্রকাশ ১২.৩.১৮৭৬ সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিম্নরূপ-
...এখানকার নাট্যশালান্তর্গত রঙ্গভূমির সমস্ত উপকরণই ইহারা পরিবর্তিত করিয়া নতুন রূপে উপস্থাপিত করিয়াছে এবং উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট দৃশ্য [ছেঁড়া] অতীব চমৎকারজনক, এ পর্যন্ত কোনও অভিনেতৃদল, ঢাকায় এরূপ অত্যুৎকৃষ্ট সীন ও সাজ পোশাক প্রদর্শন করেন নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। ইন্দ্রসভার অভিনয় দর্শনেও দর্শকবৃন্দ সন্তুষ্ট হইয়াছেন সন্দেহ নাই।
...উল্লিখিত বিবরণ অবলম্বন করিয়া যে গীতাভিনয় হইয়াছে, সাধারণ বলিতে গেলে তাহা অতি উৎকৃষ্ট হইয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অভিনয়ের প্রত্যেক অংশ ধরিয়া সমালোচনা করা যায়, তাহা হইলে দোষ মুক্ত বলা যাইতে পারে না। অস্বাভাবিকতা অনেকস্থলেই লক্ষিত হইয়াছে। প্রস্তাব বাহুল্যভয়ে তৎসমুদায় প্রদর্শন করা হইল না। যাহা হউক এই কোম্পানী যে অভিনয় কার্য বিলক্ষণ সুশিক্ষিত ও উচ্চশ্রেণীস্থ বড় মানুষ দর্শকগণের দর্শনোপযোগী উপকরণ সম্পন্ন তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। প্রহসনের অভিনয়ও সাধারণের প্রীতিজনক হইয়াছিল। ভরসা করি এই অভিনয় কোম্পানী ঢাকা হইতে বিলক্ষণ প্রতিপত্তি ও অর্থলাভ করিয়া যাইতে পারিবেন। আগামীকল্য হইতে এক সপ্তাহ কাল পর্যন্ত প্রতি রাত্রিতে ইহারা অভিনয় করিবেন সঙ্কল্প করিয়াছেন।

ঢাকা প্রকাশ ১২ মার্চ ১৮৭৬ সংখ্যায় প্রকাশিত আরেকটি সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিম্নরূপ-
...এই কোম্পানী গত দুই বৎসর যাবত নাটকাভিনয়, গান, বাদ্য এবং নানা প্রকার দৃশ্যের পরিপাট্যে, কলিকাতাস্থ সকল শ্রেণীর লোকদিগকে সন্তুষ্ট এবং আমোদিত করিয়াছেন। তাঁহারা গত রাত্রিতে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে ঢাকাস্থ জনসমাজের নিকট ইন্দ্র সভার অভিনয় কার্যে বিশেষ নৈপুণ্য ও পরিপাট্য প্রদর্শন করিয়াছেন।
পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি গৃহে আগামীকল্য সোমবার হইতে শনিবার পর্যন্ত প্রত্যেক রাত্রিতে অভিনয় ও গীত বাদ্য জনগণের মনোরঞ্জন করিতে চেষ্টা করিবেন। ৮ ঘটিকার সময় রঙ্গভূমির দ্বার উদঘাটিত হইবে এবং ৯ ঘটিকার সময় সমবেত বাদ্যের সহিত অভিনয় আরম্ভ হইবে। প্রত্যেক রজনীতে নতুন নতুন গান এবং দৃশ্যাদি প্রদর্শিত হইবে। অভিনয় এবং গীতাদি সমুদয় হিন্দুস্থানী ভাষায় হইবে। 
... টিকেটের মূল্য নির্ধারিত হইয়াছে। প্রথম শ্রেণী ৪ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণী ২ টাকা, তৃতীয় শ্রেণী ১ টাকা, চতুর্থ শ্রেণী 11. আনা
পাটুয়াটুলী কোম্পানীর বাসগৃহে এবং রঙ্গভূমির দ্বারদেশে প্রাপ্তব্য।
১৮৭৯ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি ঢাকায় নাটক মঞ্চস্থ করে। নাটকের মহিলা চরিত্রে বারবণিতারা অভিনয় করেন। ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় প্রথম মহিলা অভিনেত্রী আনলে প্রাচীনপন্থিরা রুষ্ট হন। এ নিয়ে এক বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার বিভিন্ন মহল ও সংবাদপত্রে হৈ চৈ হয়। এমন পরিস্থিতিতে নওয়াব খাজা আবদুল গনি ও নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ নাট্যমঞ্চে মহিলাদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে প্রগতিশীল চিন্তার পরিচয় দেন এবং মহিলাদের অংশগ্রহণকে সমর্থন করেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ লিখেছেন-
নওয়াব আবদুল গনি কেবল আধুনিক ভাবাপন্নই নন, প্রগতিশীলও ছিলেন। ১৮৭৯ সালে ঢাকার ইস্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক হলে স্ত্রীলোকেরা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করলে প্রাচীনপন্থীগণ রুষ্ট হন এবং স্ত্রীলোক অভিনীত নাটক দেখা ছাত্রদের পক্ষে অনুচিত বলে তাদের অভিমত জ্ঞাপন করেন। তদনুসারে স্কুলের হেড মাস্টারগণ ঐরূপ নাটক দেখা থেকে ছাত্রদের বিরত থাকার আদেশ দেন। কিন্তু নওয়াব আবদুল গনি, জমিদার মোহিনীমোহন দাস প্রমুখ এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন।
ঢাকার পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি জগন্নাথ কলেজ ও ব্রাহ্মসমাজ গৃহের পাশে থাকায় তখনকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এক সময় আপত্তি তোলে। এমতাবস্থায় সংস্কৃতিমনা নওয়াব আহসানুল্লাহ কুমারটুলিতে তাঁর বরফের কলের পাশে একটি ঘরকে নাট্যাভিনয়ের কাজে ব্যবহার করতে দেন।
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দেও কলকাতার স্টার থিয়েটার কোম্পানি ঢাকার মঞ্চে মহিলা শিল্পীদের দ্বারা অভিনয় করান। ১৮৮৭ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ থেকে জানা যায় যে, ঢাকার নওয়াব তাঁর স্কুলগামী পুত্রকে মহিলা শিল্পীদের দ্বারা অভিনীত নাটক দেখার অনুমতি দেন।
নওয়াব আবদুল গনির পুত্র নওয়াব আহসানুল্লাহ ছিলেন খাজা পরিবারের মধ্যে এক ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন কবি, গীতিকার, সুরস্রষ্টা, গায়ক, আলোকচিত্রী ও নাট্যকার। নাটক লেখার প্রতি নওয়াব আহসানুল্লাহর ঝোঁক ছিল। তিনি কয়েকটি উর্দু নাটক রচনা করে সেগুলো নওয়াব পরিবারে থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ করেন।
তবে তাঁর রচিত নাটকগুলোর পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। নাটকগুলোর মঞ্চায়ন সম্পর্কে জানা গেলে নওয়াব পরিবারের নাট্যচর্চা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের সামনে উন্মোচিত হতো। নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আসানুল্লাহর সময় নাচগান ও নাটক মঞ্চায়নের জন্য আহসান মঞ্জিলের ভেতরে আলাদা থিয়েটার হল ছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আহসানুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় নাট্যচর্চা হতো। নাট্যকাররা নাটক রচনা করতেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নাট্যমোদীদের উদ্যোগে তা মঞ্চস্থ হতো।  
শায়খুল মুহম্মদ হুসাইন ওয়াফির (মৃত্যু ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে) ছিলেন একজন প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট কবি খাজা আবদুর রহিম সাবার নাতিন জামাই। নওয়াব আহসানুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়াফির ‘বীমার বুলবুল’ নামে উর্দু ভাষায় একটি নাটক রচনা করেন। নাটকটি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। রচনার সাথে সাথেই নাটকটি ঢাকায় মঞ্চস্থ হয়ে সমাদৃত হয়। ওয়াফির এটিকে শেকসপিয়ার ও বেনজনসের অনুসরণে ইংরেজি নাটকের কায়দায় লিখেছেন বলে দাবি করেন। তবে আসলে এটি অপেরাধর্মী গীতপ্রধান নাটিকা। ওয়াফির ‘বীমার বুলবুল’ ছাড়া আরো কয়েকটি নাটক লেখেন বলে জানা যায় কিন্তু নাটকগুলোর নাম জানা যায়নি। নওয়াব আহসানুল্লাহর নির্দেশেই তিনি নাটক রচনার ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হোন বলে তাত্ত্বিকদের অভিমত।
নওয়াব আহসানুল্লাহর নিকট আত্মীয় মির্জা ফকির মোহাম্মদ (১৮৭৯-১৯৫৯) এর পিতা মির্জা ওয়ালীজান কামার ছিলেন একজন কবি, নাট্যকার ও অভিনেতা। ওয়ালীজান কামার উর্দু ও ফার্সি জানতেন। তাঁর লেখা নাটক আহসান মঞ্জিলে মঞ্চস্থ হতো। তাঁর লেখা নাটকে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন মীর্জা হায়াত।
খাজা পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে জড়িত আরেকজন নওয়াব সৈয়দ মুহম্মদ আজাদ (১৮৫০-১৯১৬) ছিলেন উপমহাদেশে উর্দুর সর্বপ্রথম গদ্য নাটকের স্রষ্টা! তাঁর উর্দু ভাষায় রচিত নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘নওয়াবী দরবার’‘নওয়াবী খেল’। নওয়াবী দরবার ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত। সামাজিক এই নাটকটি ঢাকায় কয়েকবার মঞ্চস্থ হয়।
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি সংখ্যায় সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ’ (সংগৃহীত সংবাদ অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-১৭)পত্রিকায় খবর ছাপা হয় যে,  নওয়াব আহসানুল্লাহর পুত্র নওয়াব সলিমুল্লাহ ও তিন কন্যার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমোদ-প্রমোদ হয়নি। তাই নওয়াব সাহেব ঢাকাবাসীদের অভিনয় দেখানোর জন্য কলকাতার স্টার থিয়েটার (টীকা- ২) কোম্পানি আনবেন।
...নবাব সংসারের আমোদ-প্রমোদ অনেকদিন হইতে বন্ধ আছে। পুত্র ও তিনটি কন্যার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু লোকে কোনই আমোদ উপভোগ করে নাই। যাহাতে লোক বহু লক্ষ টাকা ব্যয় হইবার আশা করিয়াছিল, তাহাতেই কিছুমাত্র পরিলক্ষিত হয় নাই , তখন এ সময় ঐ সংবাদ রটনা হইবার কারণ বুঝিতেছি না ?
সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর ৭ এপ্রিল ১৮৯৫ সংখ্যার সংবাদে লেখা হয়-
‘নবাব আহসানুল্লাহ খান সি আই ই বাহাদুর ঢাকাবাসীর এবং নিজ পরিবারস্থ ব্যক্তিবর্গের নিমিত্ত কলিকাতা হতে স্টার থিয়েটার কোম্পানীকে বহু অর্থ ব্যয়ে আনয়ন করতঃ নিজ বাসভবনেই অভিনয় আরম্ভ করাইয়াছেন। নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা অভিনয় দেখিয়া নবাব বাহাদুরকে ধন্যবাদ দিতেছেন। আমরাও তাঁর ধন্যবাদ করিতেছি।‘
ঢাকা প্রকাশের ৭ এপ্রিল ১৮৯৫ সংখ্যার সূত্রে জানা যায়, নবাব বাড়িতে ওই সময় স্টার থিয়েটার প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রতিরাতে বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ করে। নাটক দেখার জন্য নওয়াব ঢাকার গণমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও আমন্ত্রণ জানান। এদের মধ্যে ছিলেন কমিশনার লটসন জনসন, সাব অরডিনেট জাজ, মুন্সেফ, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল এবং বড় বড় জমিদারগণ।
ঢাকা প্রকাশ ১৪ এপ্রিল ১৮৯৫ সংখ্যায় (সংগৃহীত সংবাদ অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-১৭) ঢাকা প্রকাশ লেখে-
...‘নবাব বাহাদুর নিজে দণ্ডায়মান থাকিয়া। সকলকেই সাদর সম্ভাষণ ও অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন।‘
পত্রিকায় আরো লেখা হয়-
...বহু সহস্র টাকা ব্যয়ে ঢাকাবাসীকে স্টারের অভিনয় প্রদর্শনের জন্য নওয়াব আহসানুল্লাহ খান বাহাদুরকে অন্তরের সহিত ধন্যবাদ জানাইতেছি।
ওই সময় স্টার থিয়েটার চন্দ্রশেখর, লায়লী মজনু, বিবাহবিভ্রাট, তরুবালা, ঋষ্যশৃঙ্গ, বাবু ইত্যাদি নাটক প্রদর্শক করে। স্টার থিয়েটার কোম্পানি নওয়াব বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পর পটুয়াটুলীস্থ ক্রাউন থিয়েটার ও নারায়ণগঞ্জে নাটক প্রদর্শন করে।
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ২৪ আগস্ট নওয়াব গনি ও ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর নওয়াব আহসানুল্লাহর মৃত্যুতে নওয়াব পরিবারের আনন্দ উৎসবে ভাটা পড়ে। নতুন নওয়াব সলিমুল্লাহ ব্যস্ত ছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে। নওয়াব সলিমুল্লাহ নাচ-গান নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তিনি কলকাতায় ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অমরন্দ্রোনাথ দত্তের আমন্ত্রণে ক্লাসিক থিয়েটারে ‘শিবাজী’ নাটক দেখেন বলে জানা যায়। এ নিয়ে তৎকালীন মিহির ও সুধাকর পত্রিকায় বিরূপ মন্তব্যও করা হয়।
নওয়াব পরিবারের গৃহ শিক্ষক ও পরবর্তীকালে নওয়াব সলিমুল্লাহর শ্বশুর কাজী কাইউমের সূত্রে জানা যায়, ১৯০৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ইদুল আজহার দিন নওয়াব সলিমুল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্যান্যকে নিয়ে বিনা খরচে ক্লাসিক থিয়েটার দেখার জন্য।
খাজা শামসুল হকের ডায়েরির সূত্রে জানা যায় নওয়াব বাড়িতে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে একটি নাটক মঞ্চায়নের কথা। ১৭ ও ১৮ জুনের ডায়েরিতে লেখা হয় নাটকের মঞ্চ তৈরির কথা। এই নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন খাজা শামসুল হক, খাজা ইসমাইল এবং আরো অনেকে। নাটকটির নাম ছিল ‘আলফ্রেড আলেকজান্ডার’
বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা, স্বদেশী আন্দোলন, অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ প্রভৃতির কারণে ১৯০৫ থেকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। ওই সময় নওয়াব সলিমুল্লাহ খুবই অস্তিরতার মধ্যে দিনাতিপাত করেন। এর প্রভাব পড়ে সমগ্র নওয়াব পরিবারে। ফলে নাচ-গান-নাটক প্রভৃতি আমোদ প্রমোদ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় না।
নওয়াব সলিমুল্লাহর ছোট ভাই নওয়াব খাজা আতিকুল্লাহ, ঢাকার প্রথম ছবির ক্যামেরাম্যান খাজা আজাদ, খাজা খলিল ও খাজা মওদুদ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট(সংগৃহীত ডায়েরি অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-২৩) রাতে ডাক্তারখানা তথা বর্তমান ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতাল মঞ্চে নাটক দেখতে যান।
নওয়াব সলিমুল্লাহর সময় অর্থসংকটের কারণে আগের মতো নাটকের পৃষ্ঠপোষকতা করা সম্ভব হয়নি। নওয়াব হাবিবুল্লাহর আমলে খাজা পরিবারের কিছু সংস্কৃতমনা সদস্যের উদ্যোগে নাট্যচর্চায় নবরূপ পরিগ্রহ করে। খাজা পরিবারের কিছু উৎসাহী যুবকেরা এইসময় নিজেরাই নাটকে অভিনয় শুরু করেন। নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ তাদের সার্বিক সহযোগিতা করতেন।
আহসান মঞ্জিলের বড় বড় হল রুমের কোন একটিতে মঞ্চ সাজিয়ে তারা নাট্যাভিনয় করতেন। নাটকগুলো সাধারণত উর্দু ভাষায় হতো। পুরুষেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করতো। তবে মাঝে মধ্যে বাইরে থেকে অভীনেত্রী আনা হতো। ঐ সময় যেসব নাটক অভিনিত হতো তারমধ্যে ইহুদিকা লাড়কা, সোহরাব রুস্তম, বিমার বুলবুল, লায়লা মজনু, শিরি ফরহাদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নওয়াবজাদা আতিকুল্লাহ এসব নাটক আয়োজনে সংশ্লিষ্টদের সার্বিক সহযোগিতা এবং প্রায় প্রতিটি নাটকেই দর্শক হিসেবে উপস্থিত থেকে উৎসাহ দিতেন।
খাজা হকের ডাইরী পাঠে জানা যায় ১৯২২ সনের ২৭ ফেব্রুয়ারি(সংগৃহীত ডায়েরি অংশে দ্রষ্টব্য। পৃ-২৩)  নওয়াবজাদী আমিনার সৈয়দ আব্দুস সেলিমের স্ত্রীর ৪০ দিনের ছটি উৎসব উপলক্ষে সেদিন আহসান মঞ্জিলের ডাইনিং হল কক্ষে ন্যাট্যাভিনয়ের আয়োজন করা হয়। রাত নয়টায় অনুষ্ঠিত উক্ত অনুষ্ঠানে সবাইকে দাওয়াত করা হয়। অনুষ্ঠানে গুর্খা সৈন্যরা বাদ্য পরিবেশন করে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহল্লায় কোথাও কোন ভালো নাটক মঞ্চস্থ হলে খাজা আতিকুল্লাহ পরিবারের কয়েকজনকে সাথে করে নিয়ে তা দেখতে যেতেন। খাজা মওদুদের লেখা ডাইরী থেকে জানা যায় ১৯১৭ সালের ৮ আগস্ট রাতে নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ, খাজা খলিল, খাজা আজাদ ও খাজা মওদুদকে নিয়ে তৎকালীন ডাক্তারখানা মঞ্চে (বর্তমান ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) নাটক দেখতে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উপলক্ষে যুদ্ধ তহবিলে অর্থ সংগ্রহের জন্য উক্ত নাটক চলছিল। টিকিটের হার ছিল দুই পয়সা। নাটক শেষে রাত একটায় তারা বাসায় ফেরেন। এর আগের দিন খাজা আতিকুল্লাহ খাজা মওদুদকে নিয়ে ইবি, এস, আর (বর্তমানে অবলুপ্ত মাহবুব আলী মিলনায়তন) ঠাঁটারী বাজারের মিলনায়তনে ম্যাজিকশো দেখার জন্য গিয়েছিলেন।
নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ তাঁর জন্মদিন ২৬ জুলাই পরিবারের লোকদের নিয়ে ঘটা করে পালন করতেন। ঐদিন খাজা আতিকুল্লাহ নিজের বাড়িতে গান বাজনার আয়োজন করতেন। পরিবারের অনেকেই সেদিন তাকে গান গেয়ে শোনাতেন। কেউ কেউ আবৃত্তি করতেন। সন্ধ্যায় চলতো ভ্যারাইটি শো বা ফ্যান্সীবল। এই উপলক্ষে নিশাত বানুর পিতা খাজা বাহাউদ্দিন একবার চীন দেশীয় হকার সেজে সুন্দর অভিনয় করেছিলেন। খাজা আতিকুল্লাহর জন্মদিনে অনেক সময় নাটক মঞ্চস্থও করা হতো। পূর্ববঙ্গে বায়োস্কোপ চর্চায়ও নওয়াব পরিবার অগ্রনী ভূমিকা পালন করে।
খাজা মওদুদের ডাইরী থেকে জানা যায়, ১৯২০ খ্রি. ২০ জানুয়ারি খাজা আতিকল্লাহ খাজা মওদুদকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় যান। সেখানে তাঁরা ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন হলে এবং মঞ্চে নাটক ও বায়োস্কোপ দেখেন।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে খিলাফত আন্দোলন চলাকালে হাকিম হাবিবুর রহমান ‘গরীব হিন্দুস্থান' নামে উর্দু ভাষায় একটি নাটক লিখে ঢাকায় মঞ্চস্থ করেন। এই নাটক মঞ্চায়নকালে নওয়াব পরিবারের লোকজনদের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।
নওয়াব ইউসুফ জানের অধঃস্তন আত্মীয় খাজা আবদুল হালিম সূত্রে নওয়াব পরিবারের নাট্যচর্চা সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। তাঁর পিতা খাজা আবদুল গফুর (১৮৯৬-১৯৩০) ছিলেন একজন নাট্যামোদী। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে আহসান মঞ্জিলে মঞ্চস্থ ‘চেঙ্গিস খান’ নাটকে তিনি অভিনয় করেন। এতে নওয়াবজাদা খাজা নসরুল্লাহ, খাজা জহির, খাজা নঈম প্রমুখ অভিনয় করেন। উর্দু ভাষায় নাটকটি পরিচালনা করেন মোস্তফা হোসেইন।
খাজা আবদুল হালিমও (জন্ম ১৯২১) অভিনয় করেছেন বিভিন্ন নাটকে। মোসলেম হাইস্কুলে পড়ার সময় নাটকের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে খাজা এনায়েতুল্লাহর পরিচালনায় নওয়াব বাড়িতে মঞ্চস্থ উর্দু ‘মোস্তফা কামাল’ নাটকে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। এই নাটকে আরো অভিনয় করেন খাজা ফজলুল হক, খাজা ফাহিম, খাজা আতাহার, খাজা কুদরতউল্লাহ প্রমুখ। একই বছর খাজা এনায়েতুল্লাহর পরিচালনায় উর্দুতে মঞ্চস্থ হয় ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’ নাটক। এ নাটকে ও খাজা হালিম অভিনয় করেন।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নাচঘরে (সংগৃহীত সংবাদ, পৃ-২২) ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘শাইলক দি জিউ’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। এতে খাজা হালিম, খাজা ফজলুল হক, খাজা কায়সার, খাজা ফাহিম প্রমুখ অভিনয় করেন।
প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ খাজা ইউসুফ রেজার (১৯১৯-১৯৯৩) সূত্রে জানা যায়, ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে নওয়াব বাড়িতে ‘ইহুদী কি লাড়কী' নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার তথ্য। এ নাটকে, খাজা ইসমাইল, খাজা আবদুল গফুর, খাজা জহির, খাজা এনায়েত, খাজা নাঈম, খাজা আখতাঁর, খাজা শরফুদ্দীন প্রমুখ অভিনয় করেন।  
১৯২০ থেকে ১৯৬০ দশক পর্যন্ত ঢাকার মঞ্চ চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, বেতার ও ক্রীড়া অঙ্গনে তারকার দ্যুতি নিয়ে বিরাজ করেছেন খাজা আজমল (১৯০৫ ১৯১৭)। সিনেমা চর্চায় ঢাকার নওয়াব পরিবার অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে। এব্যাপারে দিলখুশাবাসী নওয়াব পরিবারের লোকেরাই অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে ছিলেন-নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহর জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা মোঃ আজাদ এবং দুই ভাগিনা (নওয়াবজাদি মেহেরবানুর পুত্র) খাজা মোঃ আদেল ও খাজা মোঃ আজমল। বিভিন্ন সময়ে তারা আহসান মঞ্জিল কিংবা দিলখুশায় নাট্যানুষ্ঠান করার সময় সেগুলোর কিছু কিছু দৃশ্য মুভিক্যামেরাবন্দী করতেন। এভাবে ছবি তোলার শখটি তাদেরকে শেষ পর্যন্ত চলচিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করছিল। এজন্য তারা গঠন করেন পূর্ববাংলার সর্ব প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি'। এই প্রতিষ্ঠানের সফল ও পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচ্চিত্র ছিল ‘দি লাস্ট কিস' নামক বিখ্যাত চলচ্চিত্র। দি লাস্ট কিস ছবি তৈরির আগে তারা পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করেছিলেন স্বল্প দৈর্ঘের একটি ছবি ‘সুকুমারী'। এর চিত্রগ্রাহক ছিলেন খাজা মোঃ আজাদ। নায়ক ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও খাজা মোঃ আদেল। নায়িকা চরিত্রে মেয়ে সেজে অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আঃ সোবহান। দিলখুশা বাগানবাড়িতে এই ছবির সুটিং হয়েছিল। দি লাস্ট কিস ছবির পরিচালক ছিলেন অম্বুজ গুপ্ত। প্রথম দিকে নায়ক ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ। পরের দিকে তার স্থলে কাজী জালালুদ্দিন ও খাজা আজমল নায়কের অভিনয় করেন। ছবিটির চিত্র গ্রাহক ছিলেন খাজা মোঃ আজাদ ও খাজা মোঃ আজমল। তাদেরকে ক্যামেরায় সহযোগিতা করেন খাজা জহির। নায়িকা ছিলেন লোলিটা (চিত্র-১৩)
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় বেতারকেন্দ্র চালুর পর খাজা আজমল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এখান থেকে আন্দালিব শাদানীর রচনা ও প্রযোজনায় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম উর্দু নাটক ‘চাদিকে টুকরা’ প্রচারিত হয়। এই নাটকে অন্যান্যের সঙ্গে অভিনয় করেন খাজা আজমল। খাজা আজমল ঢাকায় চলচ্চিত্রের যেমন প্রথম নায়ক তেমনি হকি, টেনিস, ফুটবলের ক্ষেত্রেও প্রথম সারির ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও রাজনৈতিক প্রশ্নে নওয়াব পরিবারের সদস্য খাজা নাজিমুদ্দীন, শাহাবুদ্দীন ও আবদুস সেলিম বাঙালি স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও চুয়ান্নর নির্বাচন নওয়াব ও পরিবারের ক্ষমতা ও আধিপত্যকে খর্ব করে দেয়। কাজেই পূর্ববঙ্গের ঢাকাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নৃত্য, সঙ্গীত, ক্রিড়া, নাট্যচর্চা প্রভৃতি থেকে ক্রমে দ্যোতী ছড়ানো নবাব পরিবারের ভূমিকা লোপ পায়।



         টীকা   
         আহসান মঞ্জিল
         বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কুমারটুলি এলাকায় ঢাকার নওয়াবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারির সদর কাচারি। বর্তমানে জাদুঘর।    কথিত আছে, মুগল আমলে এখানে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ এনায়েতউল্লাহর রঙমহল ছিল। পরে তাঁর পুত্র মতিউল্লাহর নিকট থেকে রঙমহলটি ফরাসিরা ক্রয় করে এখানে একটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৮৩০ সালে খাজা আলীমুল্লাহ ফরাসিদের নিকট থেকে কুঠিবাড়িটি কিনে নেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে এটি নিজের বাসভবনে পরিণত করেন। এ বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আব্দুল গনি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করান যার প্রধান ইমারত ছিল আহসান মঞ্জিল। ১৮৫৯ সালে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। আবদুল গনি তাঁর পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে ভবন এর নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রঙমহল এবং পূর্বেকার ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল। ১৮৮৮ সালে ৭ এপ্রিলে প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়, বিশেষ করে অন্দরমহলটি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। নওয়াব আহসানুল্লাহ অন্দরমহলটি পুনর্নির্মাণ এবং রঙমহলটি মেরামত করান। এ মেরামত কাজের জন্য রানীগঞ্জ থেকে উন্নত মানের ইট আনা হয়। মেরামত কর্ম পরিচালনা করেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। রঙমহলটির উপর বর্তমানে যে সুদৃশ্য গম্বুজ রয়েছে তা এ সময় সংযোজন করা হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুনের ভূমিকম্পে আবার আহসান মঞ্জিলের প্রভূত ক্ষতি হয়। তবে পরে নওয়াব আহসানুল্লাহ তা সংস্কার করিয়ে নিয়েছিলেন।
         আহসান মঞ্জিল এমন একটি স্থাপত্য যার সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের বেশ কিছু অধ্যায় জড়িত। উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে পাকিস্তানের প্রথম পর্ব পর্যন্ত প্রায় একশ বছর ধরে এ ভবন থেকেই পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে ঢাকার নওয়াবগণ প্রায় প্রতিদিন এখানে সালিশি দরবার বসাতেন। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী নওয়াব আহসানুল্লাহর উদ্যোগে এখানে কংগ্রেস বিরোধী বহু সভা হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের যেসব ভাইসরয়, গভর্নর ও লে. গভর্নর ঢাকায় এসেছেন, তাঁদের সবাই এখানে আগমন করেছেন। ১৮৭৪ সালে নওয়াব আবদুল গনির দানে ঢাকায় জলকলের ভিত্তি স্থাপনের জন্য বড়লাট নর্থব্রুক ঢাকায় এসে এ প্রাসাদে সান্ধ্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিন ঢাকায় এসে আহসান মঞ্জিলের আতিথ্য গ্রহণ করেন। বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনার প্রতি জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এ প্রাসাদে অবস্থান করেন।
         খাজা সলিমুল্লাহ তাঁর যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এ প্রাসাদ থেকেই পরিচালনা করেছেন। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সূতিকাগার হিসেবে আহসান মঞ্জিল আজ ইতিহাসের অঙ্গ। ঢাকার নওয়াবদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে আহসান মঞ্জিলের জৌলুসও স্তিমিত হতে থাকে। জমিদারি উচ্ছেদ আইনের আওতায় ১৯৫২ সালে ঢাকা নওয়াব এস্টেট অধিগ্রহণ করা হলে অর্থাভাবে নওয়াবের উত্তরাধিকারীদের পক্ষে এ প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
         আহসান মঞ্জিলে শিল্প সংস্কৃতি এবং নাট্যচর্চার বহু নিদর্শন পাওয়া যায়, বিশেষ করে উর্দু নাটক চর্চার ইতিহাস সুবিস্তৃত।
         আহসান মঞ্জিলের ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার ভবনটিকে সংস্কার করে জাদুঘরে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়। ১৯৮৫ সালে আহসান মঞ্জিল ও সংলগ্ন চত্বর অধিগ্রহণ করা হয়। গণপূর্ত ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের দায়িত্বে এর সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয় ১৯৯২ সালে। ওই বছর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাসাদটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এর নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং এখানে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়।
         [মোহাম্মদ আলমগীর] [সূত্র- http://bn.banglapedia.org/index.php?title=আহসান_মঞ্জিল]

         ২)
         স্টার থিয়েটার
         স্টার থিয়েটার১-
         ১৮৮৩ সালে কলকাতার ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান বিডন স্ট্রিট ও সেন্ট্রাল এভিন্যুর সংযোগস্থল) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৭ সালের ৩১ জুলাই স্টার থিয়েটার১ এর  শেষ অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। 
         স্টার থিয়েটার২-
         ১৮৮৮ সালে কলকাতার হাতিবাগানে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার ভেঙ্গে যাওয়ার পর মূলত তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাট্যকর্মীদের উদ্যোগেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মদাস সুর এবং ইঞ্জিনিয়ার যোগেন গুপ্তের নকশা অনুযায়ী থিয়েটার হাউস ও তার মঞ্চ নির্মিত হয়। এক সময় গিরিশচন্দ্র ঘোষও এর সঙ্গে যুক্ত হন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৫ মে ‘সেবক’ ছদ্মনামে গিরিশ ঘোষ রচিত নসীরাম নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নবনির্মিত হাতিবাগান স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয়।
         ১৯৮৮ সালে স্টার থিয়েটার তার গৌরবের একশ বছর পূর্ণ করে। এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে বহুবার স্টারের মালিকানা পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এর সংস্কার ও আধুনিকীকরণও হয়েছে। শেষদিকে এর মঞ্চটি ছিল ঘূর্ণায়মান। গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, অমৃতলাল, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষিরোদপ্রসাদ, অপরেশচন্দ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, দেবনারায়ণ গুপ্তসহ ৮০ জনেরও বেশি নাট্যকারের প্রায় ২৫০টি বাংলা নাটক এ মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। হিন্দি নাটক অভিনীত হয়েছে ১২টিরও বেশি। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, গঙ্গামণি, কাদম্বিনী, অমর দত্ত, দানীবাবু, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, অপরেশচন্দ্র, শিশিরকুমার,  অহীন্দ্র চৌধুরী, নীহারবালা, সরযূবালা, ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, প্রেমাংশু বসু, অনুপকুমার প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পী স্টারে অভিনয় করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঐতিহ্যমন্ডিত এ থিয়েটার হাউসটি ভস্মীভূত হয়ে যায়।
         [গণেশ মুখোপাধ্যায়] [সূত্র- http://bn.banglapedia.org/index.php?title=নাট্যমঞ্চ]
   
         ৩)
         পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি
         পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ছিলো ঢাকা শহরের থিয়েটার চর্চা এবং বিভিন্ন সভাসমিতির কেন্দ্র। ঢাকার টাউন হলের খানিকটা অভাব মিটিইয়েছিলো পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি। মন্ডি সাআহেবের কুঠি এবং পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের মাঝে বর্তমানে যেখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে ছিলো পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি সেখানে ছিলো বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত। পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি কখন স্থাপিত হয়েছিল তার সঠিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়না। তবে কতিপয় তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে, সম্ভবত ষাটের দশকের শুরুতেই 'নীলদর্পণ' অভিনয়ের মাধ্যমে এটি যাত্রা শুরু করে। ১৮৬৫ সালের এক খবরে জানা যায়, তখন আট হাজার টাকা চাঁদা উঠিয়ে এটি সংস্কার করা হয়েছিলো।
         নব্বই দশকে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ভেঙে সেখানে স্থাপন করা হয়েছিলো ক্রাউন থিয়েটার। ঢাকায় নীলদর্পণ মঞ্চস্থ হয় ১৮৬১ সালে, ধারণা করা হয় কিছু নাট্যমোদী দলবদ্ধ হয়ে ঢাকায় উক্ত নাটকের মঞ্চায়ণ করেন।
         তথ্যসূত্র- মামুন, মুনতাসীর, ২০১৭ । উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের থিয়েটার ও নাটক (বাগান বাড়ির থিয়েটার), ঢাকা, সময় প্রকাশন। পৃষ্ঠা. ৩৬-৩৭

         সংগৃহীত সংবাদ, পত্র, ডায়েরি
         ঢাকার বাবুবাজারে প্রতিষ্ঠিত 'বাঙ্গলাযন্ত্র' নামে বাংলা মুদ্রণযন্ত্র বা প্রেস থেকে ঢাকাপ্রকাশ প্রকাশিত হয়। বাঙ্গলাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকার সাভারের তেঁতুলঝোড়া গ্রামের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ব্রজসুন্দর মিত্র। প্রেস স্থাপনে তাকে আরও যারা সাহায্য করেন তাদের মধ্যে ঢাকার ধামরাইয়ের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দীনবন্ধু মৌলিক, মুন্সিগঞ্জের রাঢ়িখালের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্র বসু (বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা), ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র বসু (বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর কাকা) ও মালাখানগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রামকুমার বসু অন্যতম। কারও মতে ঢাকাপ্রকাশ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ৭ই মার্চ বৃহস্পতিবার ১৮৬১ সালে, আবার কারও মতে তারিখটি ছিল, ৮ই মার্চ ১৮৬১।
         সংবাদ
         নবাব আসানুল্লা খাঁ বাহাদুর নাকি কলিকাতা হইতে স্টার থিয়েটার কোম্পানীকে আনাইয়া ঢাকাবাসীকে অভিনয় দেখাইবেন। নবাব সংসারের আমোদ-প্রমোদ অনেকদিন হইতে বন্ধ আছে। পুত্র ও তিনটি কন্যার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু লোকে কোনই আমোদ উপভোগ করে নাই। যাহাতে লোক বহু লক্ষ টাকা ব্যয় হইবার আশা করিয়াছিল, তাহাতেই কিছুমাত্র পরিলক্ষিত হয় নাই , তখন এ সময় ঐ সংবাদ রটনা হইবার কারণ বুঝিতেছি না ?
         ঢাকা প্রকাশ; ২৭.১.১৮৯৫
         সংবাদ
         নবাব আসানুল্লা খান সি. আই. ই. বাহাদুর ঢাকাবাসীর এবং নিজ পরিবারস্থ ব্যক্তিবর্গের নিমিত্ত কলিকাতা হইতে স্টার থিয়েটার কোম্পানীকে বহু অর্থ ব্যায় আনয় করত নিজ বাসভবনেই অভিনয় আম্ভ করাইয়াছেন। নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা অভিনয় দেখিয়া নবাব বাহাদুরকে ধন্যবাদ দিতেছেন। আমরাও তাহার ধন্যবাদ করিতেছি।
         ঢাকা প্রকাশ, ৭.৪.১৮৯৫
         সংবাদ
         শ্ৰীযুক্ত নবাব আসানুল্লা বাহাদুরের গতপূর্ব শনিবার স্টার থিয়েটারের অভিনয় দেখিতে গিয়াছিলাম। ঐদিন কমিশনার মিঃ লটসন জনমন প্রমুখ সাহেবগণ, সবরডিনেট জজ, মুন্সেফ ডিঃ মাজিস্ট্রেট এবং বড় বড় জমিদারগণ নিমন্ত্রিত হইয়া গিয়াছিলেন। নবাব বাহাদুর নিজে দণ্ডায়মান থকিয়া সকলকেই সাদর সম্ভাষণ ও অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন।
         ঢাকা প্রকাশ, ১৪.৪.১৮৯৫
         সংবাদ
         জনৈক বন্ধু লিখিয়াছেন—গত সোমবার শ্রীযুক্ত নবাব সাহেবের আনীত ‘স্টার থিয়েটার' দেখিতে গিয়াছিলাম। সেদিন উকীল দলের নিমন্ত্রণ, কাজেই কোম্পানীর সর্বোৎকৃষ্ট বিয়োগান্তক অভিনয় বঙ্কিম বাবুর ‘চন্দ্রশেখর’ অভিনীত হইয়াছিল অন্যদিন কেমন হয় জানি না, কিন্তু সেদিনকার দর্শকমণ্ডলী গুণগ্রাহী বলিয়া বোধ হইল। অভিনয়ও বেশ ভালই হইয়াছিল। দুই একজন সামান্য অভিনেতার ত্রুটি ভিন্ন মূল অভিনেগণ স্বীয় স্বীয় অংশ উত্তম রূপে অভিনয় করিয়াছেন। কিন্তু একটা কথা এই, বঙ্কিম বাবুর ‘চন্দ্রশেখর’ নাটকাকারে অভিনয়ের উপযোগী করিতে গিয়া স্টার কোম্পানী একটুকু 'মতিরায়ের' প্রণালী অবলম্বন করিয়াছেন। আর এক কথা এই, ‘চন্দ্রশেখর’ পড়িলে পাঠকের যে তৃপ্তি হইবে, এ অভিনয় দেখিলে কিন্তু ততদূর তৃপ্তি হইবে না। কারণ, অভিনীত দৃশ্যগুলিতে সে চন্দ্রশেখরের ও সে প্রতাপ মূর্তি ঠিক অন্যরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। প্রতাপের অসাধারণ স্বার্থত্যাগ এবং সেই সঙ্গে মৰ্ম্মস্থলের প্রেম বহ্নির তীব্র ক্রিয়া একস্থলে এক দৃশ্যে নাট্যকার দেখাইতে চেষ্টা করিয়াও ততদূর কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। শৈবলিনীর চরিত্রও বঙ্কিম বাবু যে আদর্শে নির্মাণ করিয়াছেন অভিনয়ে তাহা হইতে একটু স্বতন্ত্র হইয়াছে। কিন্তু মোটের উপর অভিনয় যে ভালই হইয়াছে তাহার কোনও সন্দেহ নাই। স্টেজ ম্যানেজারের ক্ষিপ্রহস্ত প্রশংসনীয় হইয়াছিল ।
         ঢাকা প্রকাশ; ১৪.৪.১৮৯৫
         সংবাদ
         নবাব গৃহে আনীত স্টার থিয়েটার কোম্পানী সপ্তাহকাল যাবৎ প্রত্যহ রাত্রিতেই অভিনয় করিতেছেন। ঢাকার সমস্ত ভদ্রলোককে একসঙ্গে নাটক দেখান অসম্ভব হওয়াতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর ভদ্রলোকদিগকে ভিন্ন ভিন্ন দিন অভিনয় দেখান হইতেছে। আমরা যে প্রথম একদিন গিয়াছিলাম, ঐদিন লায়লা মজনু নাটক ও বিবাহ বিভ্রাট প্রহসন অভিনীত হইয়াছিল। স্টার থিয়েটারের সুপ্রসিদ্ধ অভিনেতা ও অভিনেত্রীবর্গ যে নিজেদের চিরাভ্যস্ত অভিনয় দ্বারা দর্শকমণ্ডলীকে সুখি করিয়াছেন, তাহা বলা বাহুল্য। যদ্যপি লায়লা মজনু নাটকের মজনু ও আব্দুল্লার সমান সঙ্গীতে মনোমুগ্ধ করিবার ক্ষমতা তাঁহাদের নাই, তথাপি স্টারের অভিনেত্রীদিগের পাঠ অনেক ভাল। স্টারের সজ্জাও অধিক পরিষ্কার। বস্তুত তাহাদের অভিনয় দেখিয়া আমরা সুখী হইয়াছি এবং বহু সহস্র টাকা ব্যয়ে ঢাকাবাসীকে স্টারের অভিনয় প্রদর্শনের জন্য নবাব আসানুল্লা খান বাহাদুরকে অন্তরের সহিত ধন্যবাদ দিতেছি।।
         ঢাকা প্রকাশ, ১৪.৪.১৮৯৫
         পত্র
         প্রেরিত পত্র
         প্রিয় মহাশয়। আমরা আপনার মাসিক গ্রামবার্তার গ্রাহক, ঐ পত্রিকায় ভবদীয় রচিত সাবিত্রী নাটিকাও যে ক্রমশ লিখিত হয়, তাহা একত্র সগ্রহ করিয়া গত এই আশ্বিন শ্রী বাবু ব্রজলাল সরকার মহাশয়ের বাটীতে অভিনয় করিয়াছি। আজকাল দেশের যে গতিক, তাহাতে নাটকাভিনয় করিয়া দুশ্চরিত্র সংশোধন করা সকঠিন। কিন্তু আমরা আপনার প্রসাদে সেই বিষয়ে কৃতকার্য হইয়াছি।
         কুসংস্কারাবদ্ধ বৃদ্ধ যুবকগণ কোন নাটক (সংস্কৃতভিন্ন) দেখিলে সন্তোষ হন , এমনকি পৌরাণিক না হইলে যারপর নাই ঘৃণা করেন, সুতরাং আমরা অভিনয় করিয়া কৃতকার্য হওয়া দূরে থাকুক বরং অপদার্থ নির্লজ্জ ও মূর্খ বলিয়া তাদের নিকটে পরিগণিত হই। কিন্তু আপনার সাবিত্রী নাটিকা মহদুদ্দেশ্যে পরিপূরক বিশেষ পৌরাণিক বিধায় তদভিনয় দর্শনে কি বৃদ্ধ, কি বালক কি যুবক স্ত্রী সকলেই বিশেষ সন্তোষ লাভ করিয়াছেন। যম রাজার দৃশ্যটি যে কি চমৎকার বোধ হয়, তাহা লিখিয়া শেষ করিতে পারিনা। সেটি যদিও আপনার আশানুরূপ অভিনয় করা হয় নাই, তথাচ যিনি ধর্মরাজের অংশ রঙ্গভূমে প্রদর্শন করেন, তাঁহার বাক্যে দর্শকমণ্ডলী নিস্তব্ধ হইয়াছিলেন। অভিনয়স্থান কৃষ্ণ বস্ত্রে মণ্ডিত, দুবারে যমদূত দণ্ডায়মান মধ্যে মধ্যে পাপী ও পাপিনীগণের চিৎকার ক্রন্দন আবার দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে কোন অসতী স্ত্রীলোক, আপন কার্যের দৃষ্টান্ত দেখিয়া মুগ্ধ প্রায় ভয়ে কাঁপিতেছে, এই সময় শ্রুত হইল, ও মা। এ দেখি সত্যিই যমপুরি, আমাদের দশাও এইরূপ হইবে, ইত্যাদি ঘটনায় আরও চমৎকারজনক হইয়াছিল। অতএব আপনার উদ্দেশ্য সফল হইয়াছে, ইতি-- পাবন-মালঞ্চী, ১২৮০/২১ আশ্বিন।
         আপনার একান্তবাধ্য
         শ্রী মুকুন্দলাল সরকার
         গ্রামবার্তা প্রকাশিকা; ১.১৯.১৮৭৩
         সংবাদ
         পার্সি 'গান ও নাটকাভিনয় কোম্পানী’ নামক একদল বোম্বাইবাসী পার্সি অভিনেতা সম্প্রতি ঢাকায় আগমন করিয়াছেন। নবাব খাজে আবদুল গণি মিঞা সাহেবের আমন্ত্রণই ইঁহাদিগের ঢাকায় আগমনের কারণ। ইঁহারা কলিকাতায়ও দীর্ঘকাল অভিনয় করিয়া তত্ৰত্য লোকদিগের সন্তোষোৎপাদন পূৰ্ব্বক বিলক্ষণ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন গত রজনীতে উক্ত কোম্পানী অত্ৰত্য পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে 'ইন্দ সভা’ নামক প্রসিদ্ধ হিন্দুস্থানী উপন্যাসের গীতাভিনয় ও আর একখানি প্রহসনের অভিনয় করিয়াছেন। এখানকার নাট্যশালান্তর্গত রঙ্গভূমির সমস্ত উপকরণই ইহারা পরিবর্তিত করিয়া নতুন রূপে উপস্থাপিত করিয়াছে এবং উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট দৃশ্য [ছেঁড়া] অতীব চমৎকারজনক, এ পর্যন্ত কোনও অভিনেতৃদল, ঢাকায় এরূপ অত্যুৎকৃষ্ট সীন ও সাজ পোশাক প্রদর্শন করেন নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। ইন্দ্রসভার অভিনয় দর্শনেও দর্শকবৃন্দ সন্তুষ্ট হইয়াছেন সন্দেহ নাই। তাহার স্থূল বিবরণ এই,—একদা ইন্দ্ররাজ সভার পরীগণ নৃত্যসহকারে বিবিধ গান করিতেছিল, ইতিমধ্যে সবজাপরী সভাস্থ অন্যতম দৈত্য কালাদেবকে বলে যে, 'অদ্য আমার আগমন কালে এক উদ্যান গৃহে শায়িত একটী রাজপুত্রকে দেখিয়া তৎপ্রতি আমার অনুরাগ সঞ্চার হইয়াছে, অতএব কোন কৌশল করিয়া তাহাকে তুমি আমার হস্তগত করিয়া দাও।' তদনুসারে কালাদেব উক্ত রাজপুত্রকে শূন্যপথে হরণ করিয়া এক নির্জন গৃহে সবজাপরীর নিকটে আনিয়া দেয়। তখন রাজপুত্রের নিদ্রাভঙ্গ হইলে উক্ত পরী তাহার নিকটে তাহার মনোহভিলাষ পরিব্যক্ত করে। কিন্তু রাজা তাহাতে ক্রুব্ধ হইয়া তৎপ্রতি অসন্তোষ প্রকাশ পূৰ্ব্বক তাহার পরিচয় ও ঐরূপ নির্জন গৃহে আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। সবজাপরী তাহার পরিচয়াদি প্রদান করিলে, রাজপুত্র ইন্দ্রসভা দর্শনেচ্ছু হন এবং বলেন যে যদি পরী তাহাকে ইন্দ্রসভা দেখাইতে পারে, তবে তিনি তাহার অভিলাষ পূর্ণ করিবেন। পরী তাহাতে বিবিধ বিপদাশঙ্কা দেখাইয়া রাজপুত্রকে নিবৃত্ত করিতে চায়। [ছেঁড়া] অনন্তর ইন্দ্রসভায় পরীদিগের নৃত্যগীত আরম্ভ হইলে লালদেব নামক অপর দৈত্য ইরাজ সমীপে বলে যে, অদ্য এই সভায় কোন নিয়ম বিরুদ্ধ কার্য অনুষ্ঠিত হইয়াছে— কোন মৰ্ত্তবাসী মরণশীল ব্যক্তি (মনুষ্য) এখানে আগমন করিয়াছে। তদনুসারে অনুসন্ধান আরম্ভ হয় এবং লালদেব লুক্কায়িত গোলফামকে প্রহার করিতে ২ ইরাজ সমীপে উপস্থিত করে। ইন্দ্ররাজ তাহার পরিচয় ও তথায় আগমনের হেতু জিজ্ঞাসু হইলে গোলফাম সমস্ত বৃত্তান্ত পরিব্যক্ত করেন। ইন্দ্ররাজ হাতে অতিশয় ক্রুদ্ধ হন এবং সবজাপরীকে সবিশেষ তিরস্কার করিয়া তাহার পাখা বিচ্যুত করণান্তর সভা হইতে তাড়াইয়া দেন। রাজপুত্রকেও কুপে নিক্ষেপ মতে আদেশ প্রদান করেন। অপমানিত পরী যোগিনী বেশে নানাস্থানে উক্ত রাজপুত্রের অনুসন্ধান ও নানারূপ বিলাপ করিতে আরম্ভ করে। কালাদেব তাহার সেই অবস্থা দেখিতে পাইয়া ইন্দরাজ সমীপে তদীয় গুণগ্রামের প্রশংসা করিলে ইন্দরাজ ঐ যোগিনীকে রাজ সভায় আনয়ন করিতে অনুমতি দেন। তখন সে নৃত্যগীত দ্বারা ইন্দ্ররাজাকে বিমুগ্ধ করাতে তিনি তাহাকে বহুমূল্য পুরষ্কার প্রদান করিতে চান। কিন্তু সে তৎপ্রতি আগ্রহে অসম্মত হইয়া বলে, যদি ইন্দ্ররাজ অভীম্পিত বিষয় পূর্ণ করিতে অঙ্গীকার করেন, তবে সে তাহার অভিলাষ ব্যক্ত করিতে পারে। ইন্দ্র 'তথাস্ত' বলিয়া সম্মতি দান করিলে গোলফামের উদ্ধার [ছেঁড়া] পরীর বেশে স্বকীয় পরিচয় দান করে। তখন ক্রোধপরবশ হইয়াও স্বসম্মান রক্ষার্থে প্রতিজ্ঞা পালনে পরাস্মুখ হইলেন না। পরীও গোলফাম পরস্পর প্রেমালিঙ্গন করিলে যবনিকা পতন হয়।
         উল্লিখিত বিবরণ অবলম্বন করিয়া যে গীতাভিনয় হইয়াছে, সাধারণ বলিতে গেলে তাহা অতি উৎকৃষ্ট হইয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অভিনয়ের প্রত্যেক অংশ ধরিয়া সমালোচনা করা যায়, তাহা হইলে দোষ মুক্ত বলা যাইতে পারে না। অস্বাভাবিকতা অনেকস্থলেই লক্ষিত হইয়াছে। প্রস্তাব বাহুল্যভয়ে তৎসমুদায় প্রদর্শন করা হইল না। যাহা হউক এই কোম্পানী যে অভিনয় কার্য বিলক্ষণ সুশিক্ষিত ও উচ্চশ্রেণীস্থ বড় মানুষ দর্শকগণের দর্শনোপযোগী উপকরণ সম্পন্ন তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। প্রহসনের অভিনয়ও সাধারণের প্রীতিজনক হইয়াছিল। ভরসা করি এই অভিনয় কোম্পানী ঢাকা হইতে বিলক্ষণ প্রতিপত্তি ও অর্থলাভ করিয়া যাইতে পারিবেন। আগামীকল্য হইতে এক সপ্তাহ কাল পর্যন্ত প্রতি রাত্রিতে ইহারা অভিনয় করিবেন সঙ্কল্প করিয়াছেন।
         ঢাকা প্রকাশ; ১২.৩.১৮৭৬
         সংবাদ
         নবাব আব্দুল গণি সি, এস, আইর নিমন্ত্রণে পার্সি নাটক কোম্পানী ঢাকা নগরীতে আসিয়াছেন। এই কোম্পানী গত দুই বৎসর যাবত নাটকাভিনয়, গান, বাদ্য এবং নানা প্রকার দৃশ্যের পরিপাট্যে, কলিকাতাস্থ সকল শ্রেণীর লোকদিগকে সন্তুষ্ট এবং আমোদিত করিয়াছেন। তাঁহারা গত রাত্রিতে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে ঢাকাস্থ জনসমাজের নিকট ইন্দ্র সভার অভিনয় কার্যে বিশেষ নৈপুণ্য ও পরিপাট্য প্রদর্শন করিয়াছেন।
         পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি গৃহে আগামীকল্য সোমবার হইতে শনিবার পর্যন্ত প্রত্যেক রাত্রিতে অভিনয় ও গীত বাদ্য জনগণের মনোরঞ্জন করিতে চেষ্টা করিবেন। ৮ ঘটিকার সময় রঙ্গভূমির দ্বার উদঘাটিত হইবে এবং ৯ ঘটিকার সময় সমবেত বাদ্যের সহিত অভিনয় আরম্ভ হইবে। প্রত্যেক রজনীতে নতুন নতুন গান এবং দৃশ্যাদি প্রদর্শিত হইবে। অভিনয় এবং গীতাদি সমুদয় হিন্দুস্থানী ভাষায় হইবে। 
         নিম্নলিখিত নিয়মানুসারে টিকেটের মূল্য নির্ধারিত হইয়াছে।
         প্রথম শ্রেণী ৪ টাকা
         দ্বিতীয় শ্রেণী ২ টাকা
         তৃতীয় শ্রেণী ১ টাকা
         চতুর্থ শ্রেণী 11. আনা
         পাটুয়াটুলী কোম্পানীর বাসগৃহে এবং রঙ্গভূমির দ্বারদেশে প্রাপ্তব্য।
         সন ১৮৭৬।
         তাং ১২ই মার্চ।
         ঢাকা প্রকাশ; ১২.৩.১৮৭৬
         সংবাদ
         বিগত কল্য ন্যাশনেল থিয়েটার কোম্পানীর অভিনয় দর্শকশ্রেণীর মধ্যে একটা বারাঙ্গনা দৃষ্ট হইয়াছে। অভিনেতৃদল কোন সাহসে দর্শক শ্রেণীতে একজন বেশ্যাকে গ্রহণ করিলেন এবং দর্শকবৃন্দই বা কোন মুখে একটা বেশ্যাকে লইয়া একাসনে উপবিষ্ট হইয়া অভিনয় দর্শন করিলেন, আমরা ভাবিয়াও কিছু স্থির করিতে পারিলাম না। ব্রাহ্ম সমাজ কোন প্রাণে তাহার বক্ষের উপর দিয়া যে এই সকল ব্যভিচার স্রোত করিয়া দিতেছেন, বুঝিতে পারিতেছি না। পবিত্রতার দৃঢ়বন্ধন হইতে একবার পদস্খলন হইলে যে অপবিত্রতার চরম সীমা পর্যন্ত উপনীত হইতে হয়, তাহাতে সন্দেহ কোথায়?
         ঢাকা প্রকাশ; ১০.৮.১৮৭৬
         Bengal Times 18.3.1876
         PARSEE THEATRICALS
         The principal actor having fallen sick, there was no perfor mance on Wednesday and Thursday nights. Last night (Friday), however, the parsees again made their appearance in the drama of Shakontala or the Lost Ring. Which was greatly applauded by the audience. The comical song of the Little Fisherman was sung with great spirit and all the operatic parts were well appreciated by those who were acquainted with the Urdu language. Tonight erformance is with a tale from the Arabian Nights Entertainments, which has been translated into Urdu. This company has given general satisfaction, and it is to be regreted that should make their last public appearance to night on the Dacca stage, though they will perform privately at the mansion Nawab Kajeh Abdool Gunny, C.S.I during next week.
         Bengal Times 22.3.1876
         PARSEE THEATRICALS 
         Last saturday night the Parsees gave their last and best performance at the E.B.R. theatre. Budduruddin and 'Abool Hassan' was on the programme, but it was a mixture of two tales from the Arabian nights Entertainment, Viz, the 'Sleeper Awakened' and 'Noureddin Ali' and 'Boddruddin Hassan'. The House was crowded with Natives and a few Europeans were also present. The effect of this company were not in vain, and the applause they received on saturday, was almost defeaning. Many of our readers who are familiar with the tales in the Arabian Night Entertainment know how interesting and amusing they are, especially the 'Sleeper Awakened' which was acted to perfection, each actor acquitting himself to the satisfaction of the audience. The farce in which a robber chief instructs one of his gang the art of stealing, and finally ends in the thief stealing in his chiefs house, met with great success. And the public are now looking forward to two other performances from the company, on tuesday and wednesday night.
         সংবাদ
         গত ২৪ কার্তিক শনিবার রূপট নিবাসী বি, , বিএল, শ্রীযুক্ত বাবু শশীভূষণ দত্ত মহাশয় কুমারখালী সেরাকান্দি নিবাসী শ্ৰীযুক্ত বাবু মধুসূদন সাহার বাড়িতে ‘সীতাহরণ’ নাটকাভিনয় করেন। উক্ত নাটক শশীবাবুরই রচিত। নাট্যারম্ভের পূর্বে, বিলাতি বাবু, স্কুল, সূতিকা গৃহাদির যে অভিনয় করা হয়, সর্বাপেক্ষা তাহাই আমাদিগকে অধিক সন্তুষ্ট করিয়াছে। সীতাহরণ যে একার অভিনয় করা হইয়াছে, পল্লীগ্রামে তদপেক্ষা অধিক আর কি প্রত্যাশা করা যাইতে পারে।
         গ্রামবার্তা প্রকাশিকা; ১৫.১১.১৮৭৩
         Bengal Times 8.12.1894
         THEATRICAL PERFORMANCE
         Mr. J. Lazarus, a jute merchant and to his friend Monday and Tuesday, 26th 27 th ult. He engaged the ser of the Bengal Crown theatre. They acted two pieces 'Lavla Mujnoo' and a farce styled 'Raj Bahadoor' on Monday ni and on Tuesday, they performed 'Mirabai' followed by the farce. Their acting was fairly good, and the scenery all the could be desired. This entertainment was held in 'Gole Badania house in Paniotys Lane, which belonged to Mr. J. C. Paniatvor this city, but which has recently been sold by order of the executors, to Mr. A. N. Stephan, Jute merchant.  



         তথ্যসূত্র
         মামুন, মুনতাসীর, ২০১৭ । উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের থিয়েটার ও নাটক (বাগান বাড়ির থিয়েটার), ঢাকা, সময় প্রকাশন। পৃষ্ঠা. ৩১-৩২, ৯৯-১০১
         হায়াৎ, অনুপম, ২০১৩। পুরানো ঢাকার সংস্কৃতি: নানা প্রসঙ্গ  (নওয়াব পরিবারের নাচ গান ও নাটক), ঢাকা। পৃষ্ঠা. ১০২-১১৫
         . মোঃ আলমগীর, ২০০৮। নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহর জীবন ও কর্মের আলোকে ঢাকা নওয়াব পরিবারের সমকালীন চিত্র (পঞ্চম অধ্যায়- ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিষয়ক কার্যাবলি), ঢাকা, হাসি প্রকাশনী। পৃষ্ঠা. ৮৮-৯৪
         হায়াৎ, অনুপম, ২০০১। নাওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি, ঢাকা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ। পৃষ্ঠা. ৯৪, ১১৫
         মামুন, মুনতাসীর, ১৯৮৫ । উনিশ শতকে বাংলাদেশের থিয়েটার, ঢাকা, সুবর্ণ প্রকাশনী। পৃষ্ঠা. ২৬-৩৫
         বাংলাপিডিয়া, নাট্যমঞ্চ। ইউ. আর. এল-
... ১৮৭৬ সালে নবাব আবদুল গনির আমন্ত্রণে মুম্বাই থেকে একটি দল ঢাকায় এসে হিন্দি নাটক ইন্দ্রসভা মঞ্চস্থ করে। গন্নুবাঈ, আন্নুবাঈ ও নবায়ন এই তিনবোন ইন্দ্রসভায় অভিনয় করেন। ঢাকায় মহিলাদের দ্বারা অভিনয় এই প্রথম। তাঁরা যাদুনগর নামে অপর একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেন। ১৮৮৪ সালে এখানে অভিনীত হয় উত্তররামচরিত। [জিল্লুর রহমান জন]
§  বাংলাপিডিয়া, ঢাকা নওয়াব পরিবার (সংস্কৃতি চর্চায় অবদান)। ইউ. আর. এল-
... সংস্কৃতি চর্চায় অবদান
খাজা আলীমুল্লাহর আমলে ঢাকার খাজা  পরিবারে নাচ-গান অনুপ্রবেশ করে। তাঁর সময় বিয়ে-শাদী ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে গায়ক-গায়িকা এবং বাইজীদের আনা হতো। আবদুল গনির আমলে খাজা পরিবারের সাথে গান-বাজনার সস্পৃক্ততা বেড়ে যায়। তিনি বেনারস, ফররোখাবাদ, রামপুর, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি থেকে উস্তাদ, বাইজীদের এনে নাচ-গান উপভোগ করতেন। ১৮৭৬ সাল থেকে খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে তিনি শাহবাগে যে মেলার আয়োজন করতেন তাতে নিজ ব্যয়ে নৃত্য-গীত, ম্যাজিক ও ক্রীড়া কৌতুকের ব্যবস্থা করতেন। ...
পুরান ঢাকার নাট্যচর্চা- পূর্ববঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রিক বাগানবাড়ির নাট্যচর্চা

কৃতজ্ঞতা- 
ক্যাথরিন পিউরিফিকেশন
প্রভাষক, নাট্যকলা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। 

লিখেছেন- মো. এনামুল হাসান কাওছার
শিক্ষার্থী- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.