দ্যা ডেইলি এজুখেইশনে বিজ্ঞাপন দিতে কল করুন

+88 01521 20 70 54 (Call for Ad)

বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার


বাংলা ভাষা গোড়াপত্তনের যুগে স্বল্প সংখ্যক শব্দ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও নানা ভাষার সংস্পর্শে এসে এর শব্দ সম্ভার বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে তুর্কি আগমন ও মুসলিম শাসন পত্তনের সুযােগে ক্ৰমে প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। এরপর এলাে ইংরেজ। ইংরেজ শাসনামলেও তাদের নিজস্ব সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ লাভ করে। বাংলা ভাষা ঐ সব ভাষার শব্দগুলােকে আপন করে নিয়েছে। এভাবে বাংলা ভাষায় যে শব্দসম্ভারের সমাবেশ হয়েছে, সেগুলােকে পণ্ডিতগণ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন -

১. তৎসম শব্দ
২. তদ্ভব শব্দ
৩. অর্ধ-তৎসম শব্দ
৪. দেশি শব্দ
৫. বিদেশি শব্দ



১. তৎসম শব্দ :
যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে সােজাসুজি বাংলায় এসেছে এবং যাদের রূপ অপরিবর্তিত রয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তৎসম শব্দ। তৎসম একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ তিৎ (তার)+ সম (সমান)]=তার সমান অর্থাৎ সংস্কৃত। 

উদাহরণ : চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য ইত্যাদি।
মনে রাখার কৌশল: 
সু পাত্র দেখে কন্যা হস্তগত করলে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্রের ন্যায় মস্তক উজ্জ্বল হবে। গৃহিণীও মনুষ্য জাতি তাই তাদের সাথে ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী আচরণ করা উচিত।
ব্যাখ্যা: পাত্র, কন্যা, হস্ত, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, মস্তক, গৃহিণী, মনুষ্য, ধর্ম এগুলো তৎসম শব্দ। 

২. তদ্ভব শব্দ :
যেসব শব্দের মূল সংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায়, কিন্তু ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ। তদ্ভব একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ, ‘তৎ’ (তার) থেকে ‘ভব’ (উৎপন্ন)। 

যেমন -- সংকৃত-হত, প্রাকৃত-হঙ্খ, তদ্ভব-হাত। সংস্কৃত-চর্মকার, প্রাকৃত-চম্মআর, তদ্ভব-চামার ইত্যাদি। এই তদ্ভব শব্দগুলােকে আঁটি বাংলা শব্দও বলা হয় ।

মনে রাখার কৌশল: 
জোছনা কেষ্টকে ভালোবেসে নেমন্তন করতে কুচ্ছিত হলো না। ভালোবাসায় ছেরাদ্দ থাকতে হয়; শুধু গিন্নি ভেবে চন্দর রাতে ভোগ করার নাম পেন্নাম নয়।
ব্যাখ্যা: জোছনা, কেষ্ট, নেমন্তন, কুচ্ছিত, ছেরাদ্দ, গিন্নি, চন্দর, পেন্নাম এগুলো অর্ধ-তৎসম শব্দ।

৩. অর্ধ-তৎসম শব্দ :
বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে ব্যবহৃত হয়। এগুলােকে বলে অর্ধ-তৎসম শব্দ। তৎসম মানে সংস্কৃত। আর অর্ধ তৎসম মানে আধা সংস্কৃত। 

উদাহরণ : জ্যোছনা, ছেরাদ্দ, গিন্নী, বােষ্টম, কুচ্ছিত- এ শব্দগুলাে যথাক্রমে সংস্কৃত জ্যোৎস্না, শ্রাদ্ধ, গৃহিণী, বৈষ্ণব, কুৎসিত শব্দ থেকে আগত।

মনে রাখার কৌশল: 
চাঁদ রাতে গায়ে সুগন্ধি তেল মেখে প্রেয়সীর হাত, পা ও কানে চুমো দেওয়ার নাম ভালোবাসা নয়। প্রকৃত ভালোবাসার মূল কাজ হচ্ছে বই পড়ে  ভালো চাকরি পেয়ে  ভালোবাসার মানুষটিকে দুধে-ভাতে রাখা।
ব্যাখ্যা: চাঁদ, রাত, গা, তেল, হাত, পা, কান, কাজ, বই, ভাত এগুলো তদ্ভব শব্দ । 

৪. দেশি শব্দ :
বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীদের (যেমন : কোল, মুণ্ডা প্রভৃতি) ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান বাংলায় রক্ষিত রয়েছে। এসব শব্দকে দেশি শব্দ নামে অভিহিত করা হয়। অনেক সময় এসব শব্দের মূল নির্ধারণ করা যায় না; কিন্তু কোন ভাষা থেকে এসেছে তার হদিস মেলে। 

যেমন—কুড়ি (বিশ)-কোলভাষা, পেট (উদর)--তামিল ভাষা, চুলা (উনুন)--মুণ্ডারী ভাষা। এরূপ-কুলা, গঞ্জ, চোঙ্গা, টোপর, ডাব, ডাগর, চেঁকি ইত্যাদি আরও বহু দেশি শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়।
দেশি শব্দ মনে রাখার কৌশল
এক গঞ্জের কুড়ি ডাগড়, টোপর মাথায় দিয়ে চোঙ্গা হাতে, পেটের জ্বালায়- চুলা, কুলা, ডাব ও ডিংগা নিয়ে টং এর মাচায় উঠল। 
গঞ্জ থেকে এক কুড়ি ডাগর ডাব কিনে পেট পুরে আমার  পাগলি'টাকে  টোপর পড়িয়ে ডিঙ্গা নৌকায় করে চোঙ্গা মেলার থেকে  চুলা ও কুলা উপহার দিয়ে ঢেঁকিতে ভালোবাসার রসালো ধান ভাঙ্গলাম।
ব্যাখ্যা: গঞ্জ, কুড়ি, ডাগর, ডাব, পেট, টোপর, ডিঙ্গা, চোঙ্গা, চুলা, কুলা, ঢেঁকি এগুলো দেশি শব্দ । 

৫. বিদেশি শব্দ :
রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতিগত ও বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বহু শব্দ বাংলায় এসে স্থান করে নিয়েছে। এসব শব্দকে বলা হয় বিদেশি শব্দ। এসব বিদেশি শব্দের মধ্যে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি শব্দই বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সে কালের সমাজ জীবনের প্রয়ােজনীয় উপকরণরূপে বিদেশি শব্দ এ দেশের ভাষায় গৃহীত হয়েছে। এছাড়া পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, তুর্কি- এসব ভাষারও কিছু শব্দ একইভাবে বাংলা ভাষায় এসে গেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত, মায়ানমার (বার্মা), মালয়, ও চীন, জাপান প্রভৃতি দেশেরও কিছু শব্দ আমাদের ভাষায় প্রচলিত রয়েছে।

ক. আরবি শব্দ :
বাংলায় ব্যবহৃত আরবি শব্দগুলােকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়

(১) ধর্মসংক্রান্ত শব্দ : আল্লাহু, ইসলাম, ঈমান, ওজু, কোরবানি, কুরআন, কিয়ামত, গােসল, জান্নাতজাহান্নাম, তওবা, তসবি, জাকাত, হজ, হাদিস, হারাম, হালাল ইত্যাদি।

(২) প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক শব্দ : আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেমকানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মােক্তার, রায় ইত্যাদি।

আরবি শব্দ মনে রাখার কৌশল
আরবে ইসলামে বিশ্বাসী ঈমানদার ওযু গোসল করে হাদিস কোরয়ান তসবি পড়ার পর হজ যাকাত ও কোরবানী করে হারাম হালাল ও আল্লাহর পথ মেনে চলে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম হতে মুক্তির জন্য। উকিল মোক্তার মক্কেল, মুন্সেফ কিতাব,কানুন, দোয়াত,কলম নিয়ে মহকুমা আদালতে এজলাসে বসে রায় খারিজ করেন। ঈদের দিন আলেম এলেম, ইনসান বলে মুসাফির লেবুর ব্যবসায় লোকসানে আছি। বাকির ওজর কেচ্ছা দালালি বাদ দিয়ে নগদ দাও।
খ. ফারসি শব্দ :
বাংলা ভাষায় আগত ফারসি শব্দগুলােকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি।

(১) ধর্মসংক্রান্ত শব্দ :

খােদা, গুনাহ, দোজখ, নামাজ, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, রােজা ইত্যাদি।  

(২) প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক শব্দ :
কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, তারিখ, তােশক, দফতর, দরবার, দোকান, দখত, দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, বান্দা, বেগম, মেথর, রসদ ইত্যাদি।

(৩) বিবিধ শব্দ :
আদমি, আমদানি, জানােয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাশ, রফতানি, হাঙ্গামা ইত্যাদি।

গ. ইংরেজি শব্দ :
ইংরেজি শব্দ দুই প্রকারের পাওয়া যায়

(১) অনেকটা ইংরেজি উচ্চারণে : ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, কলেজ, টিন, নভেল, নােট, পাউডার,
পেন্সিল, ব্যাগ, ফুটবল, মাস্টার, লাইব্রেরি, স্কুল ইত্যাদি।

(২) পরিবর্তিত উচ্চারণে :
আফিম (Opium), অফিস (Office), ইকুল (School), বাক্স (Box),
হাসপাতাল (Hospital), বােতল (Bottle) ইত্যাদি। 

, ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ইউরােপীয় ভাষার শব্দ

(১) পর্তুগিজ :
 আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, পাদ্রি, বালতি ইত্যাদি।


পর্তুগীজ শব্দ মনে রাখার কৌশল
গীর্জারপাদ্রী চাবি দিয়ে গুদামের আলমারি খুলে তাতে আনারস পেঁপে পেয়ারা আলপিন ও আলকাতরা রাখলেন। কেরানি দিয়ে কামরা পরিষ্কার করে জানালা খুলে দিলেন। তারপর পেরেক ইস্ত্রি ইস্পাত ও পিস্তল বের করে বালতিতে রেখে বোমা বানালেন।
(২) ফরাসি :
কার্তুজ, কুপন, ডিপাে, রেস্তোরা ইত্যাদি।
ফরাসি শব্দ মনে রাখার কৌশল
ফরিয়াদি সালিশের জন্য মুনশীর জন্য কাছে নালিশ করতে গেলে বেগম বাদশাহ, জমিদার আসামীকে জরিমানা ও খাজনা দিতে বলল। আফসোস, আলুর আমদানী রপ্তানী কম হওয়ায় বাগান থেকে বস্তা ভরে মরিচ, সবজি, পশম নিয়ে পাইকারী বিক্রেতা চশমা পরা চশমখোরের কারসাজিতে বদমাস জানোয়ার সুজমিয়ার আস্তানাতে নিয়ে গেল।

(৩) ওলন্দাজ : ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন ইত্যাদি।
ওলন্দাজ শব্দ মনে রাখার কৌশল
ওলন্দাজরা ইস্কাপন , টেক্কা , তুরুপ , রুইতন , হরতন দিয়ে তাস খেলে

ঙ. অন্যান্য ভাষার শব্দ

(১) গুজরাটি : খদ্দর, হরতাল ইত্যাদি।
(২) পাঞ্জাবি : চাহিদা, শিখ ইত্যাদি।
পাঞ্জাবি শব্দ মনে রাখার কৌশল
শিখদের কাছে পাঞ্জাবির চাহিদা অনেক।
(৩) তুর্কি : চাকর, চাকু, তােপ, দারােগা ইত্যাদি।
তুর্কি শব্দ মনে রাখার কৌশল
বিবি বেগম কোর্মা খায় বাহাদুর দেশচালায়। দারোগা বাবু তাকিয়ে দেখে গালিচায়কুলির লাশ। চাকু হাতে বাবুর্চি তাইদেখে হতবাক।সুলতান মাহমুদ বন্দুকনিয়ে দৌড়ে পালায় ।
(৪) চিনা : চা, চিনি ইত্যাদি।
(৫) মায়ানমার (বার্মিজ) : ফুঙ্গি, লুঙ্গি ইত্যাদি।
মায়ানমার (বর্মি) শব্দ মনে রাখার কৌশল
বর্মিরা লুঙ্গি ফুঙ্গি পছন্দ করে।শব্দঃ লুঙ্গি ,ফুঙ্গি
(৬) জাপানি : রিক্সাহারিকিরি ইত্যাদি।

মিশ্র শব্দ :

কোনাে কোনাে সময় দেশি ও বিদেশি শব্দের মিলনে শব্দদ্বৈত সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন – রাজা বাদশী (তৎসম+ফারসি), হাট-বাজার (বাংলা+ফারসি), হেড-মৌলভি (ইংরেজি+ফারসি), হেড-পণ্ডিত (ইংরেজি+তৎসম) খ্রিষ্টাব্দ (ইংরেজি+তৎসম), ডাক্তার-খানা (ইংরেজি+ফারসি), পকেটমার (ইংরেজি+বাংলা) , চৌহদ্দি (ফারসি+আরবি) ইত্যাদি। পারিভাষিক শব্দ : বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে। এর বেশিরভাগই এ কালের প্রয়ােগ।
উদাহরণ : অম্লজান-Oxygen; উদ্যান-hydrogen; নথি-file; প্রশিক্ষণ-training; ব্যবস্থাপক manager; বেতার-radio; মহাব্যবস্থাপক-general manager; সচিব-secretary; স্নাতক graduate; 10691e4-post graduate; statie-final; yarat-periodical; spåtaget equation ইত্যাদি।

জ্ঞাতব্য :
বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার দেশি, বিদেশি, সংস্কৃত- যে ভাষা থেকেই আসুক না কেন, এখন তা বাংলা ভাষার নিজস্ব সমপদ। এগুলাে বাংলা ভাষার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে, বাংলা থেকে আলাদা করে এদের কথা চিন্তা করা যায় না। যেমন—টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, রেডিও, স্যাটেলাইট ইত্যাদি প্রচলিত শব্দের কঠিনতর বাংলা পরিভাষা সৃষ্টি নিষ্প্রয়ােজ।

তথ্যসূত্র- বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, নবম-দশম শ্রেণি।

No comments

Powered by Blogger.